বুধবার, ২২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুবাইয়ে ভিসার হাহাকার

কাটেনি স্থবিরতা কেউ জানে না সমস্যা কোথায়

জুলকার নাইন

প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালে হঠাৎ করেই বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আরব আমিরাতের ভিসা। তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু আরব আমিরাত প্রবাসী ১২ থেকে ১৫ লাখ বাংলাদেশির। এ কারণেই অনেককে সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেও দিতে হয়েছে। ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাব থাকলেও ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় তাতে যোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কর্মস্থলে ছুটি পেয়েও অনেকে দেশে আসতে পারছেন না আবার ফিরতে না পারার ভয়ে। দীর্ঘদিনের প্রবাসীরা সন্তানদের পড়াশোনা শেষ করাতে পারছেন না। কারণ ১৮ বছর হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ভিসা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা পড়ালেখা শেষ করেছে, তারাও চাকরির সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। হাতেগোনো কয়েকজন প্রবাসী ব্যবসায়ী সন্তানদেরকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করে ব্যবসায়িক অংশীদারের ভিসা নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যয়বহুল এ ভিসা নেওয়ার সুযোগই নেই বেশিরভাগ প্রবাসীর। এ ছাড়া আগে একটি কোম্পানির লাইসেন্সে আট থেকে দশটি অংশীদার ভিসা করা গেলেও এখন তা মাত্র দুটি করা যায়। ফলে দিন দিন বাংলাদেশিদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে আমিরাতের ভিসা। জানা যায়, ২০১২ সালের আগস্টে আমিরাতে কর্মসংস্থান ভিসা বন্ধ হওয়ার পরের বছরের নভেম্বরে বন্ধ হয় ব্যবসায়ী ও পর্যটক ভিসা। বিশেষ পরিস্থিতিতে শুধু ঢাকার দূতাবাসের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে দেওয়া হয়েছে ভিসা। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে ২০০৬ সালে ১ লাখ ৩০ হাজার ২০৪ জন, ২০০৭ সালে ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৯২ জন, ২০০৮ সালে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন, ২০০৯ সালে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৮ জন, ২০১০ সালে ২ লাখ ৩ হাজার ৩০৮ জন, ২০১১ সালে ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ জন, ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন বাংলাদেশি আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর কেন ভিসা বন্ধ হয়ে গেল তার কোনো উত্তর নেই কারও কাছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ায় ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়। কিন্তু তারপরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি আমিরাত কর্তৃপক্ষের। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় দুবাইয়ের ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ সামনে রেখে রাশিয়াকে সমর্থন দিলে ক্ষুব্ধ হয় আরব আমিরাত। তবে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে পরে আরব আমিরাতকে ভোট দিলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এর পরও ভিসা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশিরা যেমন দেশটিতে যেতে পারছেন না, তেমনি সেখানে থাকা বাংলাদেশিরাও নানা সংকটে পড়ছেন।

কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও লিবিয়ার পর আরব আমিরাতের বাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। অথচ দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ সামনে রেখে দেশটিতে যে কর্মযজ্ঞ চলছে, সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ছিল বিশাল সুযোগ। আবার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের কোটার চেয়ে বেশি পরিমাণ বাংলাদেশি দুবাইয়ে থাকায় ভিসা বন্ধ করা হয়েছে।

দুবাই প্রবাসী মিজানুর রহমানের অভিযোগ, ‘নতুন করে আমিরাতে শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা না দেওয়ার মূল কারণ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সচিবরা যে পরিমাণে আমিরাত সফর করেন, তার একটি অংশও যদি আমিরাতের প্রতিনিধিদের ঢাকায় নেওয়া সম্ভব হতো তাহলেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যেত। কিন্তু সরকার তা করছে না বা করতে পারছে না। দুই বছর আগে বর্তমান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার নিলেও দুবাইয়ের বিষয়ে তার কোনো উদ্যোগই নেই।’ তবে দুবাইয়ের ভিসার বিষয়ে পদক্ষেপে সম্পৃক্ত থাকা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানালেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিসার বিষয়ে আমিরাতের সঙ্গে সেই প্রথম দিকেই আলোচনা হয়েছে। তখন আমিরাতের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে তা করা হয়েছে। কিন্তু এখন আর এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের আহ্বানেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন সেখানে উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় কোনো সফরও আয়োজন হচ্ছে না। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার আশা থাকলেও শেষ পর্যন্ত শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দেয়নি আমিরাত। ফলে কার্যত কাজে আসেনি উচ্চপর্যায়ের সেই সফর। দ্বিপক্ষীয় সফর না থাকায় বহুপক্ষীয় কয়েকটি সম্মেলনে দুই  দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে বন্ধ শ্রমবাজার খোলার বিষয়টি তোলা হলেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। সর্বশেষ জিএফএমডি (গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন আমিরাত প্রবাসীরা। সেখানেও ইতিবাচক ইঙ্গিত মেলে। এরপর থেমে যায় সেই প্রক্রিয়া। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ বলেছেন, আমিরাতে ভিসা পুনরায় বড় আকারে চালুর চেষ্টার কোনো কমতি নেই। আশা করা হচ্ছে সুবিধাজনক সময়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সফরের মাধ্যমে শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর