বুধবার, ২২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছাদ কৃষিতে সবুজ নগরজীবন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ছাদ কৃষিতে সবুজ নগরজীবন

ছাদে গাছের বাগান পরিচর্যা করছেন এক নারী —জয়ীতা রায়

চিলেকোঠার টবে উঁকি দিচ্ছে লাল টমেটো, কাঁচা মরিচ আর ঝুমকো বেগুন। সিঁড়ি ধরে নামতেই চোখ জুড়ায় আম, জাম আর লিচু মিলিয়ে প্রায় ৩১৮টি গাছের কচি পাতার ঘ্রাণ। বড় গাছের বৃত্ত থেকে মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে লালশাকের কোমল পাতা। আর ছাদের ধার ঘেঁষে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে লাউ, মিষ্টিকুমড়া আর শিমের কচি ডোগা। রাজধানীর শ্যামলী  পিসি কালচার এলাকার নাজ তাহেরের ৪ হাজার বর্গফুটের ছাদের দৃশ্য এটি। গত ৩০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টায় তার শখের বাগান রূপ নিয়েছে ছাদ কৃষিতে। নাজ তাহেরের মতো এমন উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা এখন বাড়ছে। রাজধানী পাড়ার গণ্ডি পেরিয়ে এ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে মফস্বলের অলিগলিতে। শস্য শ্যামল বাংলার প্রকৃতি চোখ জুড়ায় তার সবুজের অভয়ারণ্যে। কিন্তু সভ্যতার চাকায় ভর করে ইট-কাঠ, পাথরের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। তাই প্রকৃতি বাঁচিয়ে সবুজের স্পর্শ পেতে নীলাভ আকাশের নিচের খোলা ছাদকেই বেছে নিচ্ছেন দালানের বাসিন্দারা। প্রথম দিকে ছাদের কোণায় টবে রকমারি মৌসুমি ফুল লাগানো ছিল মানুষের শখ কিন্তু শৌখিনতা থেকে এখন কৃষি খাতে অবদান রাখতে শুরু করেছে ছাদের ফলমূল-সবজি। ছাদ কৃষির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কথা হয় কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব চ্যানেল আইয়ের পরিচালক এবং বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজের সঙ্গে। বলতে গেলে তিনিই ছাদ কৃষির প্রথম উদ্যোক্তা এবং অনুপ্রেরণাদাতা। তিনি বলেন, ‘অনেকেরই শখ থাকে বাড়ির বেলকুনি বা ছাদে ফুল গাছ লাগানোর। আমি ৮০-এর দশকে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে কাজী পেয়ারা লাগানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। তখন অনেকেই ছোট গাছে বড় আকারের পেয়ারা দেখে উৎসাহিত হয়ে শুরু করে কাজী পেয়ারার চাষ। দেশে এই পেয়ারার জাতের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ড. কাজী বদরুদ্দোজা, তাই তার নাম অনুসারেই নাম হয় কাজী পেয়ারা। এখন ছাদে ফুল গাছ থেকে বের হয়ে ফল, সবজি এবং ঔষধি গাছের চাষ করছে নগরবাসী। তাই এ বড় পরিসরকে আমি নাম দিয়েছি ছাদ কৃষি।’ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খানম ইস্কাটন রোডের বাসভবনের ছাদে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ছাদ কৃষি। ফলের মধ্যে রয়েছে আম, আমড়া, জাম্বুরা, পেয়ারা, কুল আর কামরাঙ্গা গাছ। আর অধিকাংশ ফল গাছই বারোমাসি জাতের।

 সবজির মধ্যে বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ আর পরম যত্নে বেড়ে উঠেছে কলমি শাকও। এরকম মোহাম্মদপুরের রফিকুল ইসলাম এবং তার পরিবার মিলে গড়ে তুলেছেন ফল, ফুল আর সবজির এক বিশাল সমারোহ। পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার হাতের স্পর্শে কোনো রকমের কীটনাশক আর ভেজাল ছাড়াই সতেজ আর তরতাজা হয়ে উঠছে সবুজ চারাগুলো। রফিকুল ইসলাম বলেন, নিজেদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা তিনি ছাদ কৃষি থেকে উপার্জন করেন। ছাদ কৃষিকে আরও বেশি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে শাইখ সিরাজ বলেন, বর্তমানে পানি এবং মাটির অপচয় কমিয়ে ছাদ কৃষির প্রচলন হচ্ছে উন্নত বিশ্বে। ড্রপ আউট পদ্ধতিতে পানিতে পরিমাণ মতো পুষ্টি মিশিয়ে এক ফোঁটা করে গাছের গোড়ায় পৌঁছিয়ে বড় করে তোলা যাবে গাছকে। মাটির বদলে আসছে কোকোডাস্ট। জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণ। আর এই বিপর্যয় রোধে ফাঁকা তপ্ত ছাদকে শীতল করতে এবং পরিবেশকে সহনীয় করতে পারে ছাদের বিপুল পরিমাণ গাছ। এজন্য সরকারের উচিত বাড়ি তৈরির সময় যখন অনুমোদন দেওয়া হয় তখন ছাদের একটি নির্ধারিত অংশে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা। শুধু বাড়ির ছাদে নয় চীন বা কোরিয়ার মতো অফিসের বিশাল ছাদগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে যেমন পরিবেশ বাঁচবে তেমনি কমবে ফসলে অতিমাত্রায় বিষক্রিয়ার প্রভাব। ছাদ কৃষির বিকাশে সুস্থ থাকবে মানুষ, শীতল থাকবে প্রকৃতি আর সবুজ ছোঁয়ায় সতেজ হবে নগরজীবন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর