শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

আর্থিক খাতে সাইবার ঝুঁকি বেড়েছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা

মানিক মুনতাসির

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে আবারও সাইবার ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেই সঙ্গে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপও (এপিজি) মনে করে বাংলাদেশসহ, ভারত, পাকিস্তান এমনকি দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই সাইবার ঝুঁকি রয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর এক বছরের মাথায় গত ১৪ মার্চ আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-মেইল হ্যাকড্ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য সব ব্যাংক ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। নিজ প্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন সফটওয়্যারের ব্যবহার ও সংযোজনের ব্যাপারে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এপিজি জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যেসব সফটওয়্যার ব্যবহূত হয় এর বেশির ভাগই দুর্বল। এমনকি একই সফটওয়্যার দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হওয়ার কারণে হ্যাকাররা খুব সহজেই সেসব সফটওয়্যারের বিকল্প ব্যবহার রপ্ত করে ফেলে। তাই খুব সহজেই তারা যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক করতে সমর্থ হয়। ফলে যে কোনো সময় এ অঞ্চলের আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য প্রত্যেকের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছে এপিজি।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের সদস্য দেশগুলোকে সাইবার হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। সংস্থা দুটির পাঠানো অত্যন্ত গোপনীয় এক সতর্কবার্তা পর্যালেচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভারে হ্যাকাররা আড়ি পাতার চেষ্টা করছে। তারা ক্ষতিকর ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যভাণ্ডার কপি করারও চেষ্টা করে থাকতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশ্বব্যাংকের একটি চিঠির সূত্র ধরে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি এপিজির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেছে। এ সময় তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার এবং শক্তিশালী সফটওয়্যার ব্যবহারের ব্যাপারে মনোযোগী হতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে তথ্যপ্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাইবার ঝুঁকি ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়ার পরমার্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ক্ষতিকর ভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে বড় ধরনের সাইবার হামলার শিকার হয়েছিল আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান চেজ। ওই হামলায় হ্যাকাররা ব্যাংকের সুরক্ষিত তথ্যভাণ্ডারে ঢুকে পড়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টসহ মোট ৮ কোটি ৩০ লাখ অ্যাকাউন্টের তথ্য চুরি করে। এর মধ্যে ৭০ লাখের বেশি ছিল ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ হওয়া এ ঘটনা রীতিমতো কাঁপিয়ে তোলে সারা বিশ্বের আর্থিক খাতকে। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি করে হ্যাকাররা। এ দুটি ঘটনা থেকে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকদের বড় ধরনের শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হ্যামিলটন প্লেস স্ট্র্যাটেজিসের চলতি বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবারসন্ত্রাসের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। আর গত পাঁচ বছরে সাইবারসন্ত্রাস বেড়েছে ২০০ গুণ, যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এ ধরনের হামলা ঠেকাতে আর্থিক খাতের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে হ্যামিলটন প্লেস স্ট্র্যাটেজিস। এ বিষয়ে ঢাকা কার্যালয়ে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক খাতে সাইবারসন্ত্রাস নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এজন্য সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ থেকে বাঁচতে হ্যাকার বা সাইবারসন্ত্রাসীদের প্রবেশের সম্ভাব্য পথগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই কেবল আর্থিক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিভাগের ই-মেইল আইডি থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ভুয়া ই-মেইল বার্তা পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। এ ধরনের ভুয়া বার্তাযুক্ত ই-মেইল পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যেন তাতে ক্লিক না করেন, সেজন্য সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের সিস্টেমস ম্যানেজার মুহাম্মদ ইসহাক মিয়া স্বাক্ষরিত চিঠিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহায়তা চেয়ে বলা হয়েছে, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিষয়টি বিশদভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সিস্টেমের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ চাওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর