শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

কথা বলে গণহত্যার ইতিহাস

জয়শ্রী ভাদুড়ী

কথা বলে গণহত্যার ইতিহাস

২৫ মার্চ ১৯৭১। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে রাতের নিস্তব্ধ নীরবতা। হঠাৎ বেজে ওঠে পাগলা ঘণ্টা। খবর এসেছে চামেলীবাগ, ফকিরাপুল এবং মালিবাগ দিয়ে ৩৭টি ট্রাকে অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে আসছে পাকিস্তানি আর্মি। এক বুক সাহস, দেশপ্রেম আর হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে রুখতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশ। সার্চ লাইটের তীব্র আলো আর অন্ধকার ফুঁড়ে ছুটে আসে পাকিস্তানিদের ছোড়া গোলা। রক্তে ভিজে যায় বাংলার সূর্য সন্তানদের বুক। সেই কালরাতের গণহত্যা এবং পুলিশ সদস্যদের রক্তমাখা শার্ট, ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, পাগলা ঘণ্টা, হেলিকপ্টার ব্র্যান্ডের পাকিস্তানি আক্রমণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া ওয়্যারলেস, টিঅ্যান্ডটি কলোনি হাসপাতালে শহীদ যোদ্ধাদের রক্তমাখা কাঠের বেঞ্চসহ হাজারো স্মৃতি ধারণ করে কালের সাক্ষী ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির নকশা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত স্থপতি মীর আল-আমিন। ইন্টেরিয়রে ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন রশিদ বনি। সরেজমিন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের বেজমেন্টে স্মৃতিস্তম্ভ। তার ডানদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ম্যাপ। তার পাশেই কাচের গ্লাসে ঝলসে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর জাতিকে দেওয়া নির্দেশনা, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, ২৫ মার্চের ভয়াল থাবা, চোখের জল লুকিয়ে প্রিয়জনকে লেখা কোনো মুক্তিসেনার শেষ চিঠি, পুলিশের বিবর্তনের ইতিহাস। আর বামদিকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের রক্তমাখা ইউনিফর্ম, অস্ত্র, গুলি, তৎকালীন পুলিশ সদস্যদের হাজিরা বই, মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী অঞ্চলে ব্যবহার হওয়া দেশীয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন ঘটনাবহুল স্মৃতি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট অডিটরিয়াম। সেখানে কাওসার চৌধুরী এবং মোসতাক আহমেদ নির্মিত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ’ নামে ৪৫ মিনিটের এক তথ্যচিত্রে ফুটে ওঠে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ২৫ মার্চ রাতের প্রতিরোধ সংগ্রাম। ছিমছাম সাদা-নীল গ্লাসে মোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কানে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই আগুনঝরা ভাষণ। জাতির পিতার গলার ঝংকারের টানে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধু গ্যালারির সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে ভাষণ শুনছেন তিন তরুণ। ভাষণ শেষ হতেই কথা হয় কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কাজী ইয়াসির আরাফাত এবং মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তারা বলেন, জাতির পিতার ভাষণ শুনলেই শরীরে শিহরণ জাগে। মনে হয় তখন যদি জন্মগ্রহণ করতাম তাহলে অবশ্যই যুদ্ধে যেতাম। পুলিশ জাদুঘরে এসে মনে হচ্ছে নিজ চোখে দেখছি ২৫ মার্চের সেই কালো স্মৃতি আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। স্মৃতি আর ছবি নয়, লাল-সবুজ মলাটে মোড়ানো অসংখ্য বই সংরক্ষণ করা আছে এই জাদুঘরে। শুধু দেখে চোখ জুড়ানো বা মন ভরানো নয়, দর্শনার্থীরা চাইলে স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যেতে পারেন রক্তলাল কলম, চাবির রিং, স্মরণিকা, স্বাধীনতার স্মারক সংবলিত মগ এবং টি-শার্ট।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রধান উদ্যোক্তা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (সংস্থাপন) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, প্রথম প্রতিরোধ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ১১০০ এর বেশি পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাসকে তুলে ধরতে স্বপ্ন ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে জাদুঘর করার। সবার প্রচেষ্টায় তা আজ দৃশ্যমান। জাদুঘরের অন্যতম সংগঠক এআইজি আবিদা সুলতানা বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে ২৪ মার্চ থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আয়োজন করা হয়েছে বইমেলার। এ মেলা চলবে আগামীকাল ২৬ মার্চ পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যদের সম্মানিত করতে গত বছরের মতো এবারও ৩৪ জনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর