শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভূমিকম্পের ক্ষত মুছে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হিমালয়কন্যা

রুহুল আমিন রাসেল, কাঠমান্ডু থেকে ফিরে

ভূমিকম্পের ক্ষত মুছে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হিমালয়কন্যা

ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষত মুছে এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হিমালয়কন্যা নেপাল। দেশটি ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল হয় লণ্ডভণ্ড। তখন ৩ কোটি জনবসতির নেপালি অর্থনীতির ‘লক্ষ্মী খ্যাত’ পর্যটকরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। এই চিত্র এখন বদলাচ্ছে। অতীতের চেয়ে কম হলেও, আবার ভিড়ছেন পর্যটকরা। তবে ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত এই হিমালয়কন্যার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় কোটি মানুষের এখনো কান্না থামেনি।

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু ও এর আশপাশের জনপদ ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মিলেছে। নেপালের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে সংগ্রামী ও পরিশ্রমী। বিপর্যয়ে ভেঙে না পড়ে হাসিমুখে মানিয়ে নেওয়া ও উতরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যান্য উদাহরণ হলো— নেপাল। পর্যটন নেপালের সর্ববৃহৎ শিল্পখাত এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও রাজস্ব আয়ের সর্ববৃহৎ উৎস। বিশ্বের সর্বোচ্চ ১০টি পর্বতশৃঙ্গের ৮টি-ই নেপালে। ফলে নেপাল পর্বতারোহী, রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়ে আছে। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্য এবং নেপালের শীতল আবহাওয়াই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণগুলো অন্যতম। তাই তো এই সম্পদ কাজে লাগিয়ে ভূমিকম্পের ক্ষত মুছে নতুন করে পথ   চলা শুরু করেছে নেপাল। কাঠমান্ডু শহরের ব্যস্ততম এলাকা থামেল। বিশ্বের যে প্রান্ত থেকে পর্যটকরাই নেপালে আসেন, তাদের অধিকাংশই প্রথমে যান থামেলে। কম-বেশি সারাবছরই এখানে পর্যটকদের আগমন। হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, গেস্ট হাউস থেকে শুরু করে শপিংয়ে অধিকাংশ সময় জমজমাট থাকে থামেল। প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় নেপালিদের কাছে পর্যটকদের একটু কদর বেশি। তবে কোথাও কোথাও আবার ভিন্ন চিত্রও আছে। থামেল এলাকার মাঝারি মানের একটি আবাসিক হোটেলের নাম হিমালয় দর্শন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুরুজ ধরের সঙ্গে গত সপ্তাহে আলাপচারিতা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই বছর আগের ভূমিকম্পের ধকল আরও কত বছর থাকবে জানি না। অতীতে এই সময়ে হোটেলের অধিকাংশ কক্ষে অতিথি থাকতেন। এখন মাত্র কয়েকটি কক্ষে অতিথি আছেন। এসব অতিথি সবাই বাংলাদেশ, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর। অথচ ভূমিকম্পের আগে এখানে উন্নত বিশ্বের পর্যটকদের অভাব ছিল না। এখনো আছে, তা অতীতের চেয়ে কম। থামেলের পাশের এলাকা অসোন। নেপালিদের পাশাপাশি পর্যটকরাও আসেন শপিং করতে। এখানে কথা হয় রাহুল কুর্তা অ্যান্ড শাড়ি কালেকশনের শর্মি রাউনিয়ারের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই শো রুমের মূল ক্রেতা হচ্ছেন নেপালি মধ্যবিত্ত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পর্যকটরা। নেপালি পোশাকের পাশাপাশি অনেকটা সস্তা দামে শাড়ি কিনতে আসেন ক্রেতারা। কিন্তু ভূমিকম্পের পর আর ভিড় নেই। বিকিকিনি আছে, কিন্তু তা খুবই কম। তবে দিন দিন বিকিকিনি বাড়ছে বলেও জানান তিনি।  কাঠমান্ডু, ললিতপুর ও ভক্তপুর এই তিনটি জেলাই রাজধানীর অংশ। কাঠমান্ডু থেকে ট্যাক্সিতে এক ঘণ্টা সময় লাগে ভক্তপুর স্কোয়ারে যেতে। হিন্দু ধর্মের অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য এবং নেপালে বিলুপ্ত রাজতন্ত্র শাসনামলের অনেক স্মৃতিবিজড়িত ভক্তপুরে পর্যটকদের আনাগোনা সব সময় ভালোই থাকে। এখানে ট্যাক্সি থেকে পর্যটক নামা মাত্রই ভিড় করেন পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করতে আগ্রহীরা। কার চেয়ে কে কত কম অর্থে সেবা দেবেন, তারও একটা প্রতিযোগিতার দেখা মেলে। আলাপকালে কয়েকজন গাইড বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতীতে ভালো আয় ছিল তাদের। এখন কম। মাঝখানে প্রায় এক বছর আয় ছিল না বললেই চলে। কারণ— ভূমিকম্পের পর পর্যটকরা আসেননি। এখন পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। আবার গাইড হিসেবে কাজ করার লোকবলও বেড়ে গেছে। আগে যারা ছোট ছোট ব্যবসা করতেন, তারা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন। তাই কর্মসংস্থানের জন্য গাইড হচ্ছেন। ফলে গাইড বেড়ে যাওয়াতে আয়ও কমেছে। কাঠমান্ডু থেকে দুই ঘণ্টা কিংবা ভক্তপুর থেকে এক ঘণ্টা সড়ক পথে ট্যাক্সিতে যেতে সময় লাগে নাগরকোট। এখানে সুবিশাল পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে দেখা মেলে সূর্যাস্ত এবং উদয়। আর মেঘের আধিপত্য না থাকলে দূর থেকে এভারেস্টের সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। এই চূড়ায় উঠতে অতীতে পর্যটকদের দীর্ঘ লাইন থাকত বলে জানিয়েছেন স্থানীয় দোকানি সুসং রানী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত ৬ বা ৭ মাস ধরে পর্যটকদের আগমন বাড়ছে। নেপাল এমন এক জনপদ যেখানে মাউন্ট এভারেস্ট, লুম্বিনি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানসহ সমগ্র নেপালজুড়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তীর্থস্থান আছে। তাই পর্যটকদের ঢল থাকে নেপালে। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই দুই ভূমিকম্পে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত নেপালের ৭৫ জেলার মধ্যে ৩৯ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে জনসংখ্যা অধ্যুষিত ১৪ জেলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নেমে আসে বিপর্যয়। এই জেলাগুলোতে নেপালের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন। এই দুই ভূমিকম্পে প্রায় ১০ হাজার নেপালি প্রাণ হারান। ভূমিকম্পে নেপাল শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, সামাজিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পের পর প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দি গার্ডিয়ান তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, যেসব জেলায় ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে বেশি, সেখানকার দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ভারতে পাচার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। বাড়ছে শিশুশ্রমও। আরও বাড়ছে অতি দরিদ্রের সংখ্যা।

সর্বশেষ খবর