সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

মৃত্যুর মুখে সোনাদীঘি

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

মৃত্যুর মুখে সোনাদীঘি

রাজশাহী মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী সোনাদীঘির বেশকিছু অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অথচ ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঘোষণা দিয়েছিলেন— তার প্রথম কাজ হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রের সোনাদীঘি সংস্কার করে আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। সোনাদীঘিকে ঘিরে অত্যাধুনিক কিছু পরিকল্পনা ঘোষণা করে নগরবাসীকে স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় রাসিক বলেছিল, সোনাদীঘিকে সংস্কার করে নীল পানির লেকে পরিণত করা হবে। লেকে থাকবে মিনি প্যাডেল বোট। আর দীঘির চারদিকে থাকবে পায়ে চলার পথ। মাঝখানে থাকবে সুদৃশ্য কৃত্রিম আইল্যান্ড। থাকবে ন্যাচারাল পাখির রাজ্য। দীঘিতে শাপলা-পদ্ম ফুল ফোটানোর ব্যবস্থাও থাকবে। তাতে নগরবাসী অন্যরকম সৌন্দর্য উপভোগ করবে। এর পাশে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে নির্মাণ হবে ১৬তলা বিশিষ্ট ‘সিটি সেন্টার’। এই সিটি সেন্টারের নির্মাণ কাজ এখনো চলছে। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন সিটি সেন্টারের জন্য মেরে ফেলা হচ্ছে সোনাদীঘিকে। পাশাপাশি দখল আর দূষণ তো আছেই। এতে দারুণ ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। তারা মনে করছেন, সিটি সেন্টার নির্মাণ সোনাদীঘি দখলের একটি কৌশলমাত্র। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, ১৬তলা সিটি সেন্টারের ১৩ তলা পর্যন্ত কাঠামো নির্মাণ হয়েছে। সিটি সেন্টারটি পূর্ব দিকে আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের বেশকিছু অংশ ভরাট করে এরই মধ্যে মধ্যে ২০-২৫টি পিলার বসানো হয়েছে। মাটি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠেছে পিলারগুলো। এর ওপর নির্মিত হবে ভবন। দীঘির পশ্চিম দিকে মোঘলস বিরিয়ানি নামে একটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘর তৈরি করা হয়েছে। এর কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা। আর কিছু অংশ পানির ওপরেই বাঁশের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা। সোনাদীঘি দখল করে রান্নাঘর কেন, জানতে চাইলে ওই রেস্তোরার মালিক নজরুল ইসলাম সোহানের ভাই মিজানুর রহমান সোহাগ বলেন, শুনেছি পুরো দীঘিটিই ভরাট হবে। তাই ময়লা পড়ে যে অংশটি ভরাট হয়েছে, আমরা সে অংশে রান্নাঘর বসিয়েছি। এনা প্রোপ্রার্টিজের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক সারোয়ার জাহান বলেন, ‘আমরা শুধু ডেভেলপার। নিজে থেকে দীঘি ভরাট করতে পারি না। রাসিক অনুমতি দিয়েছে। দীঘির ওই অংশটিতে একটি একতলা ভবন হবে। সেখানে শুধু বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ থাকবে।’ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাসিকের নির্দেশনার কথা বলা হলেও রাসিক বলছে অন্য কথা। রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘সোনাদীঘির ওপর ভবন হচ্ছে— এটিই জানি না। রাসিকও এমন নির্দেশনা দিতে পারে না। এদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) তার আওতাধীন নগরীর ১৬৫টি পুকুর ও জলাশয় সংরক্ষণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তালিকায় সোনাদীঘি থাকা সত্ত্বেও এর ভরাটের ক্ষেত্রে নিশ্চুপ এই সংস্থাটি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আরডিএর চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, ‘সোনাদীঘি ভরাট হচ্ছে কি না তা জানি না। দীঘিটি ভরাটে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, ‘সিটি সেন্টার নির্মাণের আগে আমাদের একটি নকশা দেখানো হয়েছিল। ওই নকশায় সোনাদীঘি ঘিরে নানা পরিকল্পনা ছিল। সে নকশা বাদ দিয়ে সোনাদীঘি ভরাট করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। আমরা জানতে চাই, আগের নকশা গেল কোথায়? সোনাদীঘিকে রক্ষার উদ্যোগ না নেওয়া হলে রাজশাহী বাসীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামব।’ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সমন্বয়ক তন্ময় স্যানাল বলেন, ‘শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই দীঘিটি পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা কমিটির সভাপতি জামাত খান বলেন, ‘সোনাদীঘি আমাদের রাজশাহীর পরিচয় বহন করে। আমরা এর অপমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেব না। রাসিক, ভূমি অফিস, আরডিএর নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় সোনাদীঘি ভরাট হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আন্দোলনে নেমেই তাদের ঘুম ভাঙাব। পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ বলছেন, সোনাদীঘির ভরাটের বিষয়টি তিনি জানতেন না। তাই কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর