মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হয়রানির শেষ নেই কর্মজীবী নারীদের

জয়শ্রী ভাদুড়ী

হয়রানির শেষ নেই কর্মজীবী নারীদের

অনামিকা গার্মেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজার পদে কর্মরত ছিলেন আছিয়া সুলতানা। চাকরির শুরু থেকেই তার এক ঊর্ধ্বতন সহকর্মীর আচরণ খারাপ লাগতে শুরু করে তার। বিষয়টিকে গায়ে না মেখে এড়িয়ে যেতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু আস্তে আস্তে কুরুচিপূর্ণ কথা, বারবার ফোন,  মেসেজে বাজে মন্তব্য, ইচ্ছা করে শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা ধৈর্যের চরম সীমায় পৌঁছে যায় আছিয়ার। আর সহ্য করতে না পেরে কর্তৃপক্ষ বরাবর মৌখিক অভিযোগ করেন তিনি। আর এর জেরে তাকেই উল্টো চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করে অফিস কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বাধ্য হয়ে এক বছর না যেতেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। আছিয়ার মতো অনেক নারীকেই কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ৩০-৪০ ভাগ নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শতকরা ৪০-৫০ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। ৩০-৫০ ভাগ নারী কর্মক্ষেত্রে দুর্ব্যবহারের শিকার হন অথচ পুরুষরা শিকার হন মাত্র ১০ ভাগ। বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেকে সম্মানহানি, চাকরি থেকে অব্যাহতি বা লজ্জার ভয়ে মুখ খোলেন না। আর এই চেপে যাওয়ার প্রবণতা থেকে বাড়ছে যৌন হয়রানির ঘটনা। যৌন হয়রানি বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে রাজধানীর একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা আফরোজা খানম বলেন, প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি ২ বছর চলছে। এই সময়ে আমার প্রতিষ্ঠানের দুজন পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা আমরা পাঁচজন নারী সহকর্মীর প্রত্যেকেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। বাজে দৃষ্টিতে তাকানো, প্রয়োজন ছাড়াই হাত টেনে ধরা, কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব তারা হরহামেশাই দিয়ে থাকেন। কর্তৃপক্ষকে তাদের বিষয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, এগুলো যৌন হয়রানি হবে কেন? ওরা সহকর্মী হিসেবে ঠাট্টা-মশকরা করে। এই কথার সঙ্গে মিলিয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত লুত্ফুন্নেসা আক্তার বলেন, ঠাট্টা করতে করতে পুরুষ সহকর্মীরা তাদের সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেন। আমি আমার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বাজে আচরণের প্রতিবাদ করায় অন্য সবার তুলনায় আমাকে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। অসুস্থতা বা কোনো প্রয়োজনে ছুটি চাইতে ঘুরতে হয় এ বস থেকে ও বসের দরজায়। কাজের ভুলত্রুটি হলে তো ওই অভিযোগের কথা তুলে অকথ্য গালিগালাজ আছেই। ২০০৯ সালের ১৪ মে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কয়েকটি দিকনির্দেশনাসহ রায় দেয় হাই কোর্ট। ওই রায়ে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কেন্দ্র এবং তা পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখনো হয়নি নিরোধ কমিটি আর কর্মক্ষেত্র হয়নি সুরক্ষিত। এ ব্যাপারে নিজেরা করি এর সমন্বয়ক খুশী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিরোধ কমিটি গড়ে তোলা প্রয়োজন। শুধু কমিটি করলেই হবে না অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিতে হবে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। কোনো ধরনের আচরণ বা কাজে যৌন হয়রানি হয় এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে জনসচেতনতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর