বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর ভটভটিতে বিপজ্জনক যাত্রা

হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা, মন্ত্রীর কড়া নির্দেশও কোনো কাজে আসছে না

সাঈদুর রহমান রিমন

ভয়ঙ্কর ভটভটিতে বিপজ্জনক যাত্রা

ভটভটিতে এমন ভয়ঙ্কর যাত্রা প্রতিদিনই চলছে মহাসড়কে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা, মন্ত্রীর কড়া নির্দেশ আর প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ সত্ত্বেও সড়ক-মহাসড়কে নসিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি নামে পরিচিত যানবাহন চলাচল বন্ধ হচ্ছে না; থামছে না দুর্ঘটনাও। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এসব অবৈধ যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। গত এক বছরেই অটোরিকশা, ইজিবাইক, লেগুনা, নসিমন, টেম্পো, ভটভটি, আলমসাধু ও মহেন্দ্রর কারণে চার শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ৬০০ জন নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছে। দেশের সর্বত্রই অনিয়ন্ত্রিত এই যানবাহনগুলোর ‘বিপজ্জনক’ চলাচলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে যাত্রীসাধারণ।গত রবিবার চুয়াডাঙ্গায় এক ভটভটি দুর্ঘটনায় ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে আরও ১০ জন। বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, রংপুর, যশোর, ঝিনাইদহসহ কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ এই যান কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। অল্পবয়স্ক, আনাড়ি চালকরা এসব যান নিয়ে সড়ক-মহাসড়কে দাবড়ে বেড়ালেও যেন দেখার কেউ নেই। দুই বছর আগে সড়ক-মহাসড়ক থেকে নসিমন, করিমন ও ভটভটি প্রত্যাহারে হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু অবৈধ এই যানবাহনের খাত থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি বজায় রাখতে পুলিশের সহায়তাতেই এসব যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করে। আছে স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী মহল আর সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র। এরা মিলেমিশে মৃত্যুফাঁদ খ্যাত ভটভটি চলাচল জিইয়ে রেখেছে। ভয়ঙ্কর এই গাড়ি কখন যে কার ওপর উঠিয়ে দেয় তার ঠিক নেই। পথচারীরা নসিমন দেখলে ভয়ে রাস্তা ছেড়ে নিচে দাঁড়ায়। এমন কোনো দিন নেই কেউ না কেউ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে না। তবুও এই বেপরোয়া গাড়ি রাস্তা দাবড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ মারছে, জরিমানা দিচ্ছে। তারপর সবই স্বাভাবিক, যেন কিছুই ঘটেনি। ভটভট শব্দে নসিমন চলছে, টেম্পো সাইজের ভটভটি। বেবিট্যাক্সি সাইজের ভটভটি। আবার মাইক্রোবাস সাইজের নসিমন। বিভিন্ন সাইজের ভটভটি দিয়ে মানুষ টানা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার সড়ক-মহাসড়ক একচেটিয়া দখলে নিয়েছে নসিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটিসহ অন্যান্য যন্ত্রদানব। শুধু উত্তরাঞ্চলেই চলাচল করছে প্রায় ৪০ হাজার নসিমন, করিমন। প্রতিদিন প্রতিটি গাড়ি থেকে চাঁদা উঠছে ৩০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীসহ সারা দেশেই অভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে। মহাসড়কে স্যালো ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার বাহন নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল বন্ধে চার দফা নির্দেশনাসহ হাই কোর্ট রুল জারি করেছে। তিন বছর আগে জারি করা এক রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ এই রায় দেয়। আদালতের চার দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে : বাগেরহাট, নড়াইল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, খুলনা ও যশোর— এই ১০ জেলায় মহাসড়কে নসিমন, করিমন ও ভটভটি চলাচল বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি ও সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের অন্য জেলার মহাসড়কেও এসব অনিবন্ধিত যানবাহন চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে কতটুকু অগ্রগতি হলো তা জানিয়ে ছয় মাস পর পর হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওই ধরনের যান চলাচল করলে সংশ্লিষ্ট মালিক ও চালকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছে আদালত। মহাসড়কে কম গতির ছোট যানবাহনগুলোকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে সেগুলোর চলাচল বন্ধের জন্যট দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন বাস মালিক ও চালকরা। এরপর আদালতের নির্দেশনা এলেও অটোরিকশা ও নসিমনচালকদের আন্দোলনের মুখে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও প্রশাসনের এত নজরদারি সত্ত্বেও শুধু চাঁদাবাজির জন্যই ‘অবৈধ যন্ত্রদানবগুলো’ বন্ধ হচ্ছে না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শেষ হতে না হতেই প্রভাবশালী মহল লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ নসিমন-করিমনের চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষিপণ্যসহ মালামাল বহনের কথা বলে ভটভটি মার্কা স্যালো ইঞ্জিনের গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো হলেও সেগুলোয় এখন অবাধে যাত্রী পরিবহন চলছে। এসব নসিমন, করিমন, ভটভটির অবাধ চলাচলে অহরহ যানজটও তৈরি হচ্ছে। ইঞ্জিনচালিত অবৈধ রিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি স্থানীয় নামের কারিগরিভাবে হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে তৈরি ত্রুটিযুক্ত এসব যানবাহন দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকায় চলাচল করছে। এসব যানবাহনের কোনো লাইসেন্স নেই, রুটপারমিট বা বৈধতাসহ নেই কোনো কাগজপত্র। এসব ইঞ্জিন বা ব্যাটারিচালিত যানবাহনে গতি নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া মহাসড়ক বা গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বৈধ যানবাহন চলাচলকে স্বাভাবিকভাবে বাধাগ্রস্ত ও যানজট সৃষ্টি করছে। ঢাকায় ইজিবাইক চলে বিদ্যুৎ চুরিতে : বিদ্যুতের অপচয়ের কারণে সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো থেকে ইজিবাইক সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাজধানীর সর্বত্র এখনো ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা চলাচল করছে দাপটের সঙ্গে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা এবং মফস্বল এলাকায় বিদ্যুৎ অপচয়কারী এই যানগুলো অবাধে চলাচল করছে।

এই যানগুলোর বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে পুলিশি অভিযান চালানো হলেও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আবারও এর চালকরা যাত্রী বহন করছেন। আর যানগুলোর ব্যাটারি রিচার্জ করতে তারা আবাসিক এলাকার বিদ্যুতের লাইন, গ্যারেজ মালিকের বিদ্যুতের লাইন এবং কিছু ক্ষেত্রে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ চুরি করে তা ব্যবহার করছেন। ঢাকার বাইরে প্রায় সব এলাকায় এই গাড়িগুলো চার্জ দিতেই ঘর বা দোকান তৈরি করে ব্যবসা শুরু হয়েছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইজিবাইক যে শুধু বিদ্যুতের অপচয় করছে তা নয়, এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য ১২ ভোল্টের চার থেকে পাঁচটি ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সেই হিসাবে দেশের প্রায় ৫ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। আর চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তা রিচার্জ করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর