বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

টাকার অভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা কেউ খাচ্ছেন ভিক্ষা করে

সোহাগপুর বিধবা পল্লীর কথা

গোলাম রাব্বানী, শেরপুর থেকে ফিরে


টাকার অভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা

কেউ খাচ্ছেন ভিক্ষা করে

সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর বিধবা ও বীরাঙ্গনারা সবাই রোগে ভুগছেন। টাকার অভাবে তাদের পরিবার চিকিৎসা করাতেও পারছে না। শহীদ পরিবারের মধ্যে অনেকেই অভাবের তাড়নায় ঢাকায় ভিক্ষাও করছেন। আর শহীদদের স্ত্রীরা অধিকাংশই বয়সের ভারে রোগ-শোক নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।

বিধবাদের মধ্যে দুই বছর ধরে নুরেমান বেওয়ার শরীর অবশ হয়ে পড়ে আছে। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারছে না তার পরিবার। তার একমাত্র ছেলে চা-বিক্রেতা নুরল হক অর্থের অভাবে মাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। নুরল হক বলেন, ‘টেহার অভাবে মারে ভালা কোনো ডাক্তারের কাছে নিবার পাইছি না। ভাতার যে টেহা পাওয়া যায়, এই টেহা দিয়া ঠিকমতো খাওয়ুনই চলে না, ডাক্তার দেহামু কেমনে! অহন আমি নিরুপায়।’ এ কথা বলেই তিনি চুপ হয়ে যান। নুরেমানের মতোই দিনমণি রাকসাম, হাজেরা বেওয়া ও লাগজান বেওয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না টাকার অভাবে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমুখে ধাবিত হচ্ছেন তারা।

একাত্তরের আলোচিত গ্রাম সোহাগপুর বিধবাপল্লী। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নে এ পল্লীর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ জুলাই সকালে এই গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। হায়েনার দল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৭৮ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় স্বামীহারা নারীদের। সব পুরুষকে হত্যা করায় পুরুষশূন্য হয় পড়ে গ্রাম। তখনই গ্রামের নাম হয় ‘বিধবাপল্লী’। এই গ্রামের ৬২ জন বিধবার মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। বর্তমানে ৩০ জন বিধবা বসবাস করছেন গ্রামে। বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ভাতার টাকায় দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা হলেও ভালো কোনো চিকিৎসক দেখানো অথবা ওষুধ কেনা যায় না। আর বিধবাদের সন্তানরা কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশা চালিয়ে জীবন চালান। শহীদ কিতাব আলীর ছেলে ওসমানের বউ রহিমা ভিক্ষা করে তার পাঁচ সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখছেন। বিধবা হাজেরা বেওয়া বলেন, ‘আর কত আমাগ দুক্কের কতা কমু। অহন আর ভালা লাগে না। সরকার দিছে। আমরা আবেদন করছি। আমগরে স্বীকৃতি দিলে শেষ বয়সে একটু শান্তি লয়া মরবার পাইতাম।’ অজুফা বেওয়া বলেন, ‘আমি চোখে দেহি না। কোনো কাম-কাজ করবার পাই না। গণহত্যায় আমার স্বামী ও শ্বশুররে হত্যা করা অইছিল্। সেই দিন আমি নির্যাতনের শিকার অইছি। স্বাধীনতার পরও মানুষ আমগরে দুর দুর, ছেই ছেই করছে। পাঁচ পুলা-মাইয়া লয়া বাড়ি বাড়ি গুরছি। কেউ জায়গা দেয় নাই। অহন পুলার লগে থাকতাছি। সরকার ছয়জনরে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিছে। অহন আমরা আবেদন করছি। স্বীকৃতি পাইলে একটু স্বস্তি লইয়া মরবার পাইতাম।’ আবেদনকারী করফুলি বেগম বলেন, ‘গণহত্যায় আমার স্বামীসহ পরিবারের তিনজনরে হারাইছি। আমগর উপর যে অত্যাচার অইছে, এইডা ভাষায় কওয়ার মতন না। বুকের মধ্যে সবসুমু আগুন চাপা দিয়া কষ্ট করছি। নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিয়া ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিছি।’ সোহাগপুর গ্রামের নারী মুক্তিযোদ্ধা সমলা বেওয়া (৭৫) বলেন, ‘সেই দিনের স্মৃতি সবসুমু চোখের সামনে ভাসে। আমার স্বামী সিরাজ আলী পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে জুর আত কইরা জীবন রক্ষার লাইগা অনুরোধ করছে। তারা ছাড়ছে না। ঘর থাইকা বাইর কইরা বুকে আর পেটে গুলি করছে। আমগর পরিবারে পাঁচজনকে একইভাবে মারছে। ভয়ে ভয়ে রাইতের বেলায় বাড়ির সামনে গুছুল ছাড়া পুরান কাপড়, মশারির কাপড় দিয়া এক কবরে তিনজনরে মাডি দিছি। রাইতেই পলাইয়া বাপের বাড়িতে চইলা গেছি। তিনডা ছোট ছোট পোলাপান লইয়া মেলা কষ্ট করছি।’ বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছতে থাকেন সমলা বেওয়া। শহীদ পরিবারের সন্তান মো. কফিল উদ্দিন (৫০) বলেন, বেঁচে থাকা বিধবারা বয়সের কারণে সবাই অসুস্থ। এর মধ্যে চারজন শয্যাশায়ী। সরকারি-বেসরকারি অনুদান থেকে একজন বিধবা মাসে দুই হাজার ৮০০ টাকা পান। এ দিয়ে তাদের দিন চলে না। এদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে একটু ভালো হয়।

সর্বশেষ খবর