বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হুমকিতে সোহাগপুরের বধ্যভূমি

স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেই, ক্ষুব্ধ শহীদ পরিবার

গোলাম রাব্বানী, মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর ও সাইফুল ইসলাম, নালিতাবাড়ী

হুমকিতে সোহাগপুরের বধ্যভূমি

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা শেরপুরের সোহাগপুর বিধবাপল্লীর গণকবর সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। তবে জমির মালিকরা যে কোনো সময় এ স্মৃতিস্তম্ভ তুলে দিতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে সোহাগপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আর স্মৃতিস্তম্ভ ও গণকবরের জমি সরকার কিনে সংরক্ষণ না করলে একদিন ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে এখানকার স্মৃতি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেন, শহীদরা যে বধ্যভূমিতে শুয়ে আছেন সে জমিটুকু (সোহাগপুর) এখনো অন্যের। সরকার জমি অধিগ্রহণ না করেই অন্যের জমিতে স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি গোলঘর (বৈঠকখানা) করে রেখেছে। সরকার বদল হলেই জমির মালিক তার জমি দাবি করতে পারেন। জমির মালিক জমি বিক্রি করতে রাজি থাকলেও সরকার কিনছে না। এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় প্রয়োজনে জমিটি অধিগ্রহণ করে নেওয়া হবে। এখানকার শহীদ পবিরারগুলোর জন্য ভালো কী করা যায় তা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শহীদদের ব্যাপারে কোনো অবহেলা বরদাশত করা হবে না।’ পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত একাত্তরের আলোচিত গ্রাম শেরপুরের সোহাগপুর বিধবাপল্লী। পাকিস্তানি হায়েনার দল এই গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে একই দিন ১৭৮ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় স্বামীহারা নারীদের।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ জুলাই সকালে সোহাগপুর গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। এরপর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার এ গ্রামে গড়ে ওঠে বিধবাপল্লী। এখনো সেখানে ৩০ জন বিধবার অসহায় বসবাস চলছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের গণকবরও রয়েছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধে বিধবারা সবাই হারিয়েছেন নিজেদের স্বামী-সন্তান ও বাবা। সেই সঙ্গে নিজের সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে অনেককে। বিধবারা আজও স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে এ গ্রামে বসবাস করছেন। অনাহার-অর্ধাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই অনেকের। রাস্তার পাশে কিংবা অন্যের পরিত্যক্ত ঘরেই চলছে অনেকের বসবাস। সামাজিক বঞ্চনা ও যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংসার চললেও নিজেদের চেয়ে শহীদদের প্রতি তাদের ভালোবাসা বেশি। তাদের দাবি, শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য সরকার যেন উদ্যোগ নেয়।

এ এলাকার শহীদ পরিবারের সদস্য ও বীরাঙ্গনা হাফিজা বেওয়া। তার স্বামী, চাচাতো ভাই, জ্যাঠাতো ভাই ও বোনজামাইকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। ওই সময় তিনি একেবারে নববধূ ছিলেন। তার একটি ছেলে থাকলেও মায়ের খবর রাখে না। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে আছি। বেসরকারি জায়গার ওপর স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভটি সরকারি করা হোক। সরকারের পক্ষ থেকে জায়গাটি কিনে নিয়ে সংরক্ষণ না করলে এ স্মৃতি একদিন মুছে যাবে।’

সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও শহীদ পরিবারের সদস্য মো. জালাল উদ্দিন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘সোহাগপুরের স্মৃতিস্তম্ভ ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বেসরকারি জায়গায় স্মৃতিস্তম্ভ একসময় থাকবে না। সরকার যদি এসব জমি ক্রয় করে সংরক্ষণ করে, তবেই তা স্থায়ী হতে পারে।’ এদিকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে কৃষি সমন্বয়ক পাওয়ার টিলার, মাশরুম ও বনায়নসহ তিনটি প্রকল্প চালু করা হয়। এসব প্রকল্প থেকে বেশ সুফল পেয়েছিলেন বিধবারা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা কারণেই এসব প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। তবে সোহাগপুরের শহীদ পরিবারের সদস্যরা আবারও সরকারের পক্ষ থেকে এমন প্রকল্প চান। যেসব প্রকল্পের মাধ্যমে তারা নিজেরাই উৎপাদন করে আয় করতে পারবেন। তাহলেই তাদের জীবন-যাপন পাল্টে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

সর্বশেষ খবর