শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ধরাছোঁয়ার বাইরে সোহাগপুরের রাজাকার কাদের ডাক্তার

গোলাম রাব্বানী, মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর ও সাইফুল ইসলাম নালিতাবাড়ী থেকে

ধরাছোঁয়ার বাইরে সোহাগপুরের রাজাকার কাদের ডাক্তার

শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যার দায়ে ফাঁসির রায় হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার কাদের ডাক্তার। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন এই কুখ্যাত রাজাকার।

সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বাসিন্দারা গণমাধ্যমে তার নামে অভিযোগ করায় এই গ্রামে হামলাও চালিয়েছে কাদের ডাক্তারের ক্যাডার বাহিনী। অন্যদিকে কাদের ডাক্তারকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন এই পল্লীর বিধবারা। কাদের ডাক্তারের বিষয়ে বীরাঙ্গনা অজুফা বেওয়া বলেন, কাদের ডাক্তার বর্তমানে পলাতক। তবে আমি তাকে ঢাকার গাজীপুরায় দেখেছি। আমরা এই রাজাকারের বিচার চাই। সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মো. আবদুল কাদের আকন্দ ওরফে কাদের ডাক্তার। তার নামে ডাক্তার পদবি থাকলেও তিনি ডাক্তারি পাস করেননি। গ্রামের হাটবাজারে ক্যানভাস করে লোকজনের কাছে ওষুধ বিক্রি করতেন। এরপরই হকার থেকে হয়ে ওঠেন ডাক্তার। সেই থেকেই গ্রামের লোকজন তাকে ডাক্তার বলে সম্বোধন করেন। অষ্টম শ্রেণি পাস কাদের ডাক্তারের আদি নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার চকডাকিরকান্দা গ্রামে। বাবার নাম ছফির উদ্দিন আকন্দ (মৃত)। স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে তিনি কাকরকান্দি ইউনিয়নের বরুয়াজানী গ্রামের প্রভাবশালী ইয়াকুব মণ্ডলের মেয়েকে বিয়ে করে এই এলাকায় চলে আসেন। বাড়ি বানান উত্তর সোহাগপুর গ্রামে। বর্তমানে সেখানে তার বাড়ি ভিটাসহ ছয় একর জমিও রয়েছে। তথ্যানুযায়ী, ঘরজামাই কাদের ডাক্তারই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হয়ে ওঠেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। পাকসেনাদের খুন, ধর্ষণসহ সব অপকর্মের সাথী ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কাদের ডাক্তারসহ স্থানীয় আলবদর-রাজাকাররা পাক হানাদারদের নিয়ে সোহাগপুর গ্রামে তাণ্ডব চালায়। তারা এ গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। সম্ভ্রম নষ্ট করে ১৪ জন গৃহবধূর। লুট করে নিয়ে যায় ঘরের ধান চাল এবং গরু ছাগল। বাধা প্রদান করে লাশ দাফনে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় কেদার নাথ ডালুসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। কাদের রাজাকার পাকিস্তানি আর্মির রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প ও পাশের তেলিখালী ক্যাম্পে সেনাদের মুরগি খাসি চাল ডালের সরবরাহ দিতেন। দক্ষিণ সোহাগপুর গ্রামের হুরমুজ, খালেক, বারেক ও মালেক নামে চার ব্যক্তিকে কাদের ডাক্তার ধরে নিয়ে পাকসেনাদের রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্পে পাঠান। পরে তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে নভেম্বর মাসে কাদের ডাক্তারের নির্দেশে ফরেস্ট ক্যাম্পের পাকসেনারা সহর উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে।

সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী মো. জালাল উদ্দিনের সাক্ষ্যতেও কাদের ডাক্তারের নাম উঠে এসেছিল। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে এসে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ’৭১ সালে আমাদের শেরপুর এলাকায় রাজাকার ছিল কাদের ডাক্তার। আর বড় কমান্ডার ছিল কামারুজ্জামান। ওই সময় আলবদর ও রাজাকাররা একই ছিল। এই সাক্ষী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে কাদের ডাক্তারের সহযোগিতায় সোহাগপুরে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। কামারুজ্জামানের বিচার হলেও এখনো কাদের ডাক্তারের কিছুই হয়নি। তার আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত বলে শুনেছি। এ জন্য তার কিছুই হচ্ছে না। উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগ ছিল সোহাগপুরে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ। পরে ২০১৫ সালে ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জানা গেছে, স্বাধীনতা অর্জনের পর কাদের ডাক্তার শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানে তিনি তাদের বোঝাতে সক্ষম হন, রাজাকার হওয়াতেই বরুয়াজানী গ্রামে ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধা থাকা সত্ত্বেও এ গ্রামের কোনো ক্ষতি হতে দেওয়া হয়নি। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের জামাতার প্রতি এ তৃপ্তির ঢেঁকুরের কারণে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পাননি এত দিন। কিন্তু সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বাসিন্দারা তাদের সর্বনাশের মূল হোতা কাদের ডাক্তারের কথা বার বার উচ্চারণ করলেও- কেউ তা আমলে নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। সোহাগপুর ঘুরে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গত আমলে রাজাকার কাদের ডাক্তার আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কয়েকটি দলীয় কর্মসূচিতেও ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর সময়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে সোহাগপুরের নৃশংস গণহত্যা। তখন থেকেই জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান ও স্থানীয় রাজাকার আবদুল কাদের আকন্দের নাম শহীদ পরিবারের মুখ থেকে ওঠে আসে। এরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।  কিন্তু কামারুজ্জামানের বিচার হলেও এখনো কাদের ডাক্তার কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে- সেই প্রশ্ন সোহাগপুরের শহীদ পরিবার সদস্যদের মাঝে। একাধিক বিধবা বলেছেন, আমরা হত্যাকাণ্ডের সময় কাদের ডাক্তারকে দেখেছি। আমরা তার বিচার চাই। রাজাকার কাদের ডাক্তারের বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, আমরা এই রাজাকারের বিষয়ে অভিযোগ করেছি। আশা করছি দ্রুত তার বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের পরেই ছিল কাদের ডাক্তারের অবস্থান। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তার বিচার চাই।

সর্বশেষ খবর