শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল বাংলাদেশ

সাঈদুর রহমান রিমন

নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল বাংলাদেশ

নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখন গ্রামাঞ্চলেও নারী আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে নেই। শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মতৎপরতায় এমনকি রাজনীতিতেও সক্রিয় অবস্থান রয়েছে নারীর।

মেধা-মননেও এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারী। কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা দক্ষতা প্রমাণ করছেন। তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, পর্বত জয় করছেন। সব ধরনের খেলাধুলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরা আজ পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। কিছু হতাশা থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের অর্জন অনেক। নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে আছে বাংলাদেশ। আর বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০১৬ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের অবস্থান নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৮৭তম। ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে ১৯ ধাপ ওপরে উঠে এসেছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও অগ্রগতি ব্যাপক। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নেতা, উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার নারী। বর্তমান সংসদে ৭৩ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। ২০২০ সাল নাগাদ সব রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এই বাস্তবধর্মী পদক্ষেপের ফলে সমাজের প্রথাগত ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। আগে যেখানে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণকে সামাজিকভাবে ভালো চোখে দেখা হতো না, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীর পদচারণা দ্রুত বাড়ছে। সমান অধিকার, মর্যাদার প্রশ্নেও নারীরা তৎপর। সার্বিক বিচারে সমাজের প্রতিটি পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং বিভিন্ন কারিগরি ক্ষেত্রে নারীরা উচ্চপদে রয়েছেন। দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যুক্ত রয়েছেন অনেক নারী। ক্রিকেট, ফুটবলসহ পর্বতশৃঙ্গ জয়েও এগিয়ে এসেছেন নারীরা। নারী পুলিশ সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কাজ করছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও ভালো করছেন নারীরা। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ও স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে। এতে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৬টি দেশের নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান তুলে ধরতে ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন সেবা প্রদানকারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড। ‘ইনডেক্স অব উইমেন্স অ্যাডভান্সমেন্ট’ (আইডব্লিউএ) শীর্ষক এই জরিপে দেখা যায়, কর্মসংস্থান, সক্ষমতা এবং ব্যবসা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব— এ তিন সূচকেই বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। কর্মসংস্থান সূচকে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের উপযোগী করার ক্ষেত্রে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও এগিয়ে আছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করেছে। এ ছাড়া নারী নীতি, মানব পাচার সংক্রান্ত আইন, পর্নোগ্রাফি আইন, শিশু নীতিসহ অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। নারী উন্নয়ন ও তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন। তবে ঘরের ভিতরে এখনো নারী নানা বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি পেশায় বাংলাদেশের নারীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু বিস্ময় ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করি, নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয় না।’ মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের মডেল। কিন্তু এখনো তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। শুধু সরকারের একক চেষ্টায় এ নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, নারী উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। বর্তমানে প্রায় দুই কোটি নারীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রমে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সেলাই থেকে শুরু করে ড্রাইভিংসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। জয়ীতাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় নারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।

নারী বিনিয়োগকারী ৮ লাখ : যৌথ বিনিয়োগে তো বটেই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেও এ দেশে নারীকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। দেশের অনেক গ্রুপ অব কোম্পানির শীর্ষ পদে রয়েছেন নারী। শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারীর বিও অ্যাকাউন্ট ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪০। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, নারীকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে কাজ করছে কমিশন। এ জন্য প্রতি মাসেই নারী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনামূল্যে বিশেষ বিনিয়োগ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে নতুন নারী বিনিয়োগকারী সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবেই সময়ের চাহিদায় নারী যোগ্য হয়ে উঠছে নিজ প্রতিভায়। এসএমই উদ্যোক্তা নারীরাও এখন আর ঘরে বসে থাকছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে আসছেন তারা। ফলে দিন দিন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। ২০১২ সালে এসএমই খাতে নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয় ১ হাজার ২৭৩ জন, পরের বছর ২০১৩ সালে তৈরি হয় ৩ হাজার ৩১৭ জন। নারীদের ক্ষমতায়ন ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে নারীরা সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের ১৫ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর এ ঋণের জন্য সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা আছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকায় নারীরা সহজে ঋণ নিতে পারছেন। নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ খেলাপির পরিমাণও কম বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ খবর