শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

অপরাধ অপকর্মে অপ্রতিরোধ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

মামলা তদন্তে, অপরাধী ধরতে পুলিশকে সহযোগিতা করার নামে সোর্সরা দিন দিনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। পুলিশের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে তারা নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। স্থানীয় পর্যায়ে মাদক ও দেহব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, জায়গাজমি জবরদখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধে সরাসরি অংশ নিচ্ছে তারা। রাজধানীসহ সারা দেশেই সোর্সদের বেপরোয়া আচরণে মানুষ কমবেশি অতিষ্ঠ। ডিএমপির কয়েকটি থানায় সোর্সরাই হয়ে উঠেছে সর্বেসর্বা, মূর্তিমান আতঙ্ক।

সোর্সদের দৌরাত্ম্যে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। তারা পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে। অন্যান্য অপরাধ-অপকর্মেও অপ্রতিরোধ্য তারা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাঁধে ভর করে দাবড়ে বেড়ায় সোর্সরা। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে ঘরবাড়ি ও দেহতল্লাশিতে তত্পর হয়। অনেক সোর্স মামলার বাদী কিংবা আসামিদের পক্ষ নিয়ে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেয়। তাদের অতি বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে প্রায়ই পুলিশ কর্মকর্তারা বিপাকে পড়েন।

সোর্সরা কোনো বাহিনীর স্বীকৃত সদস্য নয়; সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে সোর্স নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষায়, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কর্মকাণ্ডে গোপন তথ্য দেওয়া, দাগি অপরাধীদের শনাক্ত করাসহ নানা কাজে সোর্সদের সহায়তা খুবই জরুরি। তা ছাড়া বিভিন্ন অভিযানকালে পুলিশের পাশাপাশি সোর্সরা ‘বিকল্প সহায়ক শক্তি’ হিসেবে দায়িত্ব পালন পালন করে। অভিযোগ উঠেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সোর্সদের ব্যবহার করা হলেও পুলিশবান্ধব সোর্সদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অতিসম্প্রতি রাজধানীতে সোর্সদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশদ অনুসন্ধান চালায়। সোর্সদের দোর্দণ্ড প্রতাপের নানা নমুনা উল্লেখ করে অনুসন্ধানকারী গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোর্সদের গলায় গলায় ভাব। এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের সঙ্গে নিয়েই পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন মামলা তদন্তে যান। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই দারোগাদের সোজাসাপটা উত্তর : ‘এরা থানার সোর্স’। কিন্তু এমন সোর্সের সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য ও সোর্স মিলে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি করছে। তথ্য পাওয়ার জন্য পুলিশ যেমন সোর্সদের খাতির করে, তেমনি অসাধু পুলিশ সদস্যদের কাছে এ সোর্সরাই ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’। তাদের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে কথিত আটক বাণিজ্যের নামে হাতিয়ে নেওয়া হয় অর্থ। দেখা যায়, এলাকার দাগি, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরাও নিজেদের স্বার্থে থানায় সোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নানা অপকর্ম করছে। ধরা পড়ার ভয়ে খোদ পেশাদার সন্ত্রাসীরাও এসব সোর্সকে ভয় পায়। সন্ত্রাসী ও পুলিশের সঙ্গে যুগপৎ সখ্যের মাধ্যমে তারা যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই ডিএমপি সদর দফতর থেকে থানাগুলোয় চিঠি দিয়ে সোর্স নামধারী অপরাধীদের ব্যাপারে ওসিদের সতর্ক হতে বলা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও রেঞ্জ পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘প্রায়ই শোনা যায়, মাদক ধরিয়ে দিলে সোর্সকে তার অর্ধেক দিতে হয়। না দিলে সে ধরিয়ে দেয় না। এমন কথা আছে যে, ধরা পড়া ইয়াবার মধ্যে অর্ধেক তারা নিয়ে যায়। কোনোমতেই এটা অ্যালাউ করা যাবে না। সোর্সকে মাদকের অর্ধেক দিলে সে তো এসব আবার বিক্রি করবে। তার মানে সে লাইসেন্সধারী মাদক বিক্রেতা হয়ে গেল।’ সোর্সদের সব ধরনের অপরাধ-অপকর্মের ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর ভূমিকা নেওয়ারও নির্দেশ দেন আইজিপি।

সোর্সরাই যেখানে সর্বেসর্বা : যাত্রাবাড়ী থানায় পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব জমিয়ে পেশাদার অপরাধীরা যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানান, সোর্সদের উৎপাতে রাস্তাঘাটে যেমন তেমন বাসাবাড়িতেও নিরাপদে থাকার উপায় নেই। ভয়ঙ্কর সব অপরাধ ঘটিয়েও সোর্সরা বরাবরই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইদানীং মামলা তদন্ত থেকে শুরু করে আসামি ধরা, থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে বেধড়ক পিটুনি দেওয়ার মতো অপকর্মেও লিপ্ত থাকছে তারা। যাত্রাবাড়ী এলাকায় অপরাধী সোর্স হচ্ছে লালন, ডেঙ্গু, রেলি ও শামীম। তাদের সহযোগী রাজু, পটপট বাবু, ইমনসহ আরও ১০-১২ জন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, আছে চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বেশ কয়েকটি করে মামলা। তবু তারা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় পুলিশের গাড়িতে, ভিআইপি স্টাইলে। দারোগা উকিল কবীর ও আমিনুলের পৃষ্ঠপোষকতা পায় তারা।

অপরাধী সোর্স যারা : অতিসম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কথিত অপরাধী সোর্সদের তালিকা সংযুক্ত রয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর ও ডেমরা থানা এলাকায় টাউক্কা রশিদ, শাজাহান, ব্ল্যাক সুমন, কামাল, বাবুল, লালবাবু, সোহাগ, ভাগিনা রবিন, ভাউয়্যা সেলিম, ফর্মা সিরাজ, মাদকসম্রাজ্ঞী রাশেদা, খোকা ও জাহাঙ্গীর সোর্স হিসেবে দাপিয়ে বেড়ায়। মুরাদপুরে সোর্স কামাল ও সোহেলের অত্যাচার থেকে কারও যেন রেহাই নেই। মতিঝিল, পল্টন, সবুজবাগ, মুগদায় হেরোইনছি স্বপন, খলিল, আক্তার, সোর্স রিপন, কুত্তা স্বপন, মরিয়ম, আজমল, মানিকনগরের শামীম, দুলাল ও বিপ্লব খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তারা যখন তখন যে কারোর বাসায় হানা দেয়, যাকে তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। প্রায়ই তারা আসামি ধরার নামে পুলিশের হ্যান্ডকাফ কোমরে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

খিলগাঁও থানা এলাকায় সোর্স পরিচয়দানকারী প্রায় সবাই ডাকসাইটে মাদক ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে লুঙ্গি মিজান, কানা নূরুল ইসলাম ওরফে তুহিন, তালতলার ডিবি ফর্মা রাজীব, র‌্যাব বাবুল, আজাহার ওরফে আদার, সেলিম, মর্তুজা, সাগর, আলমগীর, ফর্মা খালেকের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা থানা পুলিশের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব জমিয়ে নিজেরাই পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দিনের বেলার মাদক ব্যবসায়ীরা রাতেই হয়ে ওঠে ভুয়া পুলিশ কর্মকর্তা। কোমরে রাখে হ্যান্ডকাফ, হাতে থাকে নকল ওয়াকিটকি। শাহজাহানপুর থানায় সোর্স হিসেবে হালিম, বাবলা, সনিয়া, জলিল, হানিফের একচ্ছত্র দাপট চলে। বাড্ডায় গ্রিল জামাল, বরিশাইল্যা রফিক, ক্যাশিয়ার দুলালের ভাই ফর্মা বেল্লাল, সাঁতারকুলের বাবা শাহীন, রব, বাপ্পি, সুমন, মোটা বিপ্লব, ডিলা, আব্বাস, ভাটারার বাংলা নাছির, আলমগীর, ইয়াবা নাঈম, ফর্মা লিটন যা খুশি করে বেড়ালেও কারও টুঁশব্দ করার জো নেই।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি এলাকায় জসিম, চোরা লিটন, জামান মল্লিক, বিমান, জয়া, সেন্টু, শম্ভু, ইয়াবা ঝিলু, ফেনসি রমজান, কানাই, বাপ্পি, নবাবপুর-ঠাটারীবাজারে সিসিলি, কানা জাহাঙ্গীর, চান্দু, পুরি মাসুদ, কুমিল্লা রফিক, চাঁদপুইরা সফিক, মুজিবর। লালবাগ, হাজারীবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গীর চর এলাকায় সোর্স পরিচয়ে বিরানি মামুন, টুন্ডা, ইবরাহিম, জাফর, রনি, সিডি মিন্টু, সোহেল, আরিফ, বিল্লা রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। লালবাগের সোর্স রব মাত্র তিন বছরেই পাঁচ তলা বাড়ির মালিক বনে গেছেন। বৈধ আয়ের কোনো উপায় না থাকলেও চকবাজারের ফর্মা আজমল লালবাগ বাটা মসজিদ এলাকায় পরপর দুটি বাড়ি কিনে নিয়েছে। মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, শাহআলী এলাকায় পুলিশ সোর্স সাইফুল, দেলোয়ার, তারেক, রাজু, রহমান, খ্রিস্টান বাবু, তামালুপা তামু, আলমগীর— সবাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পল্লবীর সোর্স সাইফুলের নামে থানায় ডাকাতি মামলা থাকলেও তার ঘোরাফেরা ছিল পুলিশের গাড়িতেই। একই থানার আরেক সোর্স দেলোয়ারের বিরুদ্ধে পুলিশের অস্ত্র লুট, গাড়ি ভাঙচুর, ভুয়া পরিচয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স সংগ্রহ, অস্ত্রের মুখে নিরীহ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বাড়ি মালিককে অপহরণসহ মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সাইফুল-দেলোয়ারের সহযোগী হিসেবে মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিডি শামীম, টিটু, হাবিবসহ কয়েকজন। ধানমন্ডি, কলাবাগান, আদাবর ও মোহাম্মদপুরে মিন্টু, নাজির, হানিফ, রাসেল, জয়নাল, বিজয়, ফাতেমা, লালচান ও বাবু সেলিম। শাহবাগ ও নিউমার্কেটে মোটা নাদিম, মাওরা সেলিম, শাহিদা, ফর্মা কার্তিক, শামসুল আলম ফারুক, ফর্মা কাদের ও কাইল্যা বাবু এখন মূর্তিমান আতঙ্ক।

সোর্সদেরও আছে পদপদবি : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে পরিচিত সোর্সদের মধ্যেও আছে পদপদবি, সিনিয়রিটি, জুনিয়রিটি। ডিসি সোর্স, এসি সোর্স, ওসি সোর্স ইত্যাদি পদে ভূষিত তারা। পদবি অনুযায়ী ক্ষমতা আর খবরদারিত্বও কমবেশি আছে। কেউ শুধু ফুটপাথের চাঁদা তোলে, কেউ বা তোলে আসামিদের বখরা। আবার বড় বড় অপরাধে জড়িতদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে আলাদা মর্যাদার সোর্স ব্যবহার হয়ে থাকে। থানার অফিসার ইনচার্জদের নিজস্ব সোর্সরা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দাগি অপরাধীদের থেকে চাহিদামাফিক মাসোহারা আদায়ের কাজে তত্পর থাকে। এসব ছাড়াও প্রতি থানা এলাকায় পাঁচ-সাত জন করে ‘ভিআইপি সোর্স’ নামেও একটি চক্রের অস্তিত্ব দেখা গেছে। বিভাগীয় বৈধ কোনো চাকরি না হলেও সোর্সদের সাসপেন্ড আর বদলির ঘটনাও আছে বলে জানা গেছে। খিলগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ গাজী মাইনুর হাজারীবাগ থেকে জাফর নামের এক সন্ত্রাসী সোর্সকে বদলি করে এনেছেন। তিনিই খিলগাঁওয়ের সব সোর্সের সরদার হিসেবে পরিচিত। কোন সোর্স অন ডিউটিতে থাকবে, কোন সোর্সের ডিউটি অফ থাকবে, কাকে কত দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হবে তা নির্ধারণ করে সোর্স সরদার জাফর। সোর্সরাই সুখ-দুঃখে, বিপদে-আপদে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘একমাত্র বন্ধু’ হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ খবর