রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ

কুমিল্লায় সতর্ক, কোন্দল মেটানোর উদ্যোগ তৃণমূলে

রফিকুল ইসলাম রনি

ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ

ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ। নিজেদের কোন্দলের কারণে এক সিটি, তিনটি উপজেলা ও দুটি পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই দ্বন্দ্ব আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সদ্যসমাপ্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে কোন্দল নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ জন্য আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা প্রতিটি জেলায় দলের সার্বিক অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট করবেন দলীয় সভানেত্রীর কাছে। কর্মসূচি ও করণীয় নির্ধারণ করতে আজ সকালে ধানমন্ডিতে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক ডাকা হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সতর্কবার্তা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর এই বার্তা হলো দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ। এই দুর্বলতা মোকাবিলা করেই আগামী নির্বাচনে যাওয়ার কথা জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, কুমিল্লায় আমাদের দলে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কেবল কুমিল্লা নয়, সম্প্রতি চার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ সর্তকবার্তা আমরা পেয়েছি। বিএনপি যাতে এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ না নিতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলীয় সূত্রমতে, শতচেষ্টা করেও দলীয় কোন্দল মুক্ত করা যাচ্ছে না তৃণমূলে। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে এই দ্বন্দ্ব দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু কিছু এমপি নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের বাইরেও নিজস্ব ‘এমপি লীগ’ তৈরি করেছেন। দলের নেতা-কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন নেই তাদের কাছে। হাইব্রিডরাই তাদের কাছের মানুষ। এসব এমপি ও কিছু নেতা এতই বেপরোয়া যে, ‘তাদের পছন্দের’ বাইরে দলের কোনো সিদ্ধান্ত তারা মানতে নারাজ। সর্বশেষ কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে এ দ্বন্দ্বের মাশুল দিতে হলো আওয়ামী লীগকে। গত ৬ মার্চ সিলেটের ওসমানীনগর, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোন্দলের কারণে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এর আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতি এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই পরাজয় হয়।

জানা গেছে, কুমিল্লার স্থানীয় নেতা বাহার-আফজলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। কেন্দ্র থেকে বার বার নির্দেশনা এবং ২৫ জনের অধিক নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পরও দুই নেতার সমর্থকদের এক করতে পারেনি ক্ষমতসীন আওয়ামী লীগ। যা দলটিকে ভাবিয়ে তুলেছে। জানা গেছে, কুমিল্লায় প্রথমে দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নেন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম। এরপর কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় টিম গিয়ে সেখানে ধারাবাহিক বৈঠক করে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মাঠে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ফরিদুন্নাহার লাইলী, অসীম কুমার উকিল, আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, দেলোয়ার হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, হারুনুর রশিদ, শামসুন্নাহার চাপা, ডা. রোকেয়া সুলতানা, আমিনুল ইসলাম আমিন, রিয়াজুল কবির কাওছার, আনোয়ার হোসেন, ইকবাল হোসেন, রেমন্ড আরেং, গোলাম কবির রাব্বানী চিনু, মারুফা আকতার পপি, সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে ইসহাক হোসেন পান্না, অজয় কর খোকন, অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, লিয়াকত শিকদার, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, বদিউজ্জামান সোহাগ, ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন। এ ছাড়াও যুবলীগের ওমর ফারুক চৌধুরী, হারুনুর রশিদ, মহিলা লীগের সাফিয়া খাতুন, মাহমুদা বেগম ক্রিক, যুব মহিলা লীগের নাজমা আক্তারসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সেখানে রাত-দিন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড ভাগ করে নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন নির্বাচনী এলাকায়। কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও জেলা শহরের একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ভোট প্রার্থনা করেছেন তারা। এরপরও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় নেতারা বিব্রত। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শতচেষ্টা করেও দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারিনি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচন আমাদের একটা শিক্ষা দিয়েছে। দলের অভ্যন্তরে ঘুণে পোকা ধরেছে। এই পোকা পরিষ্কার করতে না পারলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাশুল গুনতে হবে। তিনি বলেন, কোন্দল নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কুমিল্লায় সুষ্ঠু নির্বাচনের আরেকটি উদাহরণ তৈরি হলেও সেখানের পরাজয় আমাদের জন্য সুখকর নয়। কারণ আমরা ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। যা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তাই দেশের যেসব স্থানে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তা মেটানোর উদ্যোগ এখনই নেওয়া হচ্ছে। আমাদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনোভাবেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া যাবে না। দল করতে হলে দলের শৃঙ্খলাও সবাইকে মানতে হবে। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে আওয়ামী লীগকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। ইতিমধ্যে স্থানীয় নেতা ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।  

দলের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা জানিয়েছেন, আজকের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকরা দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা ও উপজেলার দলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে দলীয় সভানেত্রীর কাছে লিখিত রিপোর্ট জমা দেবেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলপূর্ণ জেলাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এরপর ছোটখাটো দ্বন্দ্ব হলে সেখানে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও প্রয়োজনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হস্তক্ষেপ চাইবেন তারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলের মধ্য থেকে ব্যক্তিস্বার্থে, ব্যক্তি লোভ কাজ করবে এটা মেনে নেওয়া হবে না। স্থানীয় নির্বাচনে অনেক সময় গ্রুপিং, দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে, যেটা কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে পড়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেব। কোন্দলপূর্ণ জেলাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা সাংগঠনিক সফর শুরু করব। যে নেতাদের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে তাদের নিয়ে বৈঠক করে সমাধান করব। প্রয়োজনে দলীয় সভানেত্রীর হস্তক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর