রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ রোল মডেল অটিজম সচেতনতায়

বিশ্ব অটিজম দিবস আজ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে বটতলায় বসে ছবি আঁকছে নিশিত। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর হাসিমাখা মুখ দেখলে চার বছরের এ শিশুটিকে মনে হয় কত দিনের চেনা। কিন্তু কথা বলতে গেলেই বাধে বিপত্তি, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেও সাড়া দেয় না সে। সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন নিশিতের মা নিলুফা বেগম। জন্মের পর সুস্থ এবং স্বাভাবিক ছিল নিশিত। কিন্তু ১৮ মাস পার হতেই অস্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে তার মধ্যে। ডাকলে সাড়া দেয় না সে, ক্ষুধা লাগলেও বলে না, প্রস্রাব চাপলেও বলে না, কারও সঙ্গে খেলেও না। প্রথমদিকে পাত্তা না দিলেও আস্তে আস্তে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। অবশেষে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা নিশিতের এ সমস্যাগুলোকে অটিজম বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু অটিজম সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাদের। এরপর শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চলতে থাকে নিশিতের চিকিৎসা। এখন সে আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অল্প অল্প কথা বলে, একটু একটু করে খেলাধুলা করে এবং তার অনুভূতিগুলো বলার চেষ্টা করে। শুধু নিশিত নয়, এ রকম অসংখ্য শিশু জন্মের পর সুস্থ থাকলেও ১৮ মাস বয়স থেকে স্পষ্ট হতে থাকে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সমস্যা। এ বছর ‘আত্মনির্ভরতা এবং আত্মপ্রত্যয়ের লক্ষ্যে’ স্লোগান নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দশম অটিজম সচেতনতা দিবস। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আর্ট ক্যাম্পে দেখা মেলে অটিজমের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায় শতাধিক শিশুর। এ ছাড়া এ্যাপোলো হসপিটালসের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ফ্রি ক্লিনিক এবং ৩ এপ্রিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০০ সালে ১৫০ জনে ১ জন শিশুর মধ্যে অটিজম দৃশ্যমান ছিল, ২০০৪ সালে ১২৫ জনে ১ জন, ২০০৬ সালে ১১০ জনে ১ জন, ২০০৮ সালে ৬৮ জনে ১ জন এবং ২০১০ ও ২০১২ সালে ৬৮ জনে ১ জন শিশু অটিজম আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৫ গুণ বেশি। ৪২ জনে ১ জন ছেলে শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয় আর মেয়ে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ১৮৯ জনে ১ জন।  এ ব্যাপারে এ্যাপোলো হসপিটালসের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের প্রধান বিশেষজ্ঞ ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, এই সমীক্ষার মানে এই নয় যে অটিজম আক্রান্ত শিশুর পরিমাণ বাড়ছে, আসলে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শিশু শনাক্ত হচ্ছে। আর বাংলাদেশে অটিজম চিকিৎসায় তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রকমের টুল। বিভিন্ন দেশের চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ে জেনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে চিকিৎসা পদ্ধতি। শিশুদের যদি প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম সমস্যা চিহ্নিত করা যায় তাহলে নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু সময় পার হতে থাকলে সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করে। সাধারণত পারিবারিক সমস্যা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা বিষয়ে বলতে গিয়ে শিশু মনোবিজ্ঞানী তারানা আনিস বলেন, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করতে গেলে প্রথমে তার মনোজগতে কী ঘটছে তা বুঝতে হয়। এ জন্য তাদের আচরণ লক্ষ্য করা, আই কিউ লেভেল পরীক্ষা করা, ধারণক্ষমতা, কী ধরনের স্কুলে পড়তে হবে, কোন বিষয়গুলো সে নিতে পারছে না তা খেয়াল করতে হয়।

শিশুদের বিভিন্ন রকমের সমস্যা থাকে। যেমন, কথা বলার সময় চোখের দিকে না তাকানো, কথা বলতে দেরি করা, ভাব বিনিময় না করা, কথা গুছিয়ে না বলা, স্বাভাবিক খেলাধুলা না করা। এ জন্য অভিভাবককে শিশুদের ছোট ছোট বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং শৈশবে প্রাযুক্তিক আসক্তি কমিয়ে শিশুদের বেশি সময় দেওয়ার পরামর্শ দেন এই মনোবিজ্ঞানী। আর এই শিশুদের চিকিৎসার ব্যাপারে এ্যাপোলো হসপিটালসের ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্ট নাসরিন সুলতানা বলেন, আমরা শিশুদের সঙ্গে মিশে তার খেলা, কাজ, মনোভাব বুঝে নিয়ে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় ৬টি সেশনে আমরা তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য যে জরিপ পরিচালিত হয় তাতে দেশে ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৩০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২.৮৭ শতাংশ হচ্ছে অটিজম সম্পন্ন। অটিজম আক্রান্তদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে চালু হয়েছে শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকা সেনানিবাসে ‘প্রয়াস’ নামক একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। এ্যাপোলোসহ বেশ কয়েকটি হসপিটালসেও চলছে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা। অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বিষয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে রোল মডেল। জাতীয় সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২১) বাংলাদেশ সরকার অটিজম, নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক ইস্যুকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ‘ঢাকা ডিক্লারেশন’ এবং সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের ভূমিকা অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে সম্মান এনে দিয়েছে। অটিজম বিষয়ক পরামর্শক কমিটির চেয়ারপারসন এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ডব্লিউএইচও এক্সপার্ট অ্যাডভাইজরি প্যানেলের সদস্য হিসেবে তার কাজ বিশ্ববাসীর অনুপ্রেরণার উৎস।

সর্বশেষ খবর