মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

জান দেব তবু জমি দেব না

বছিলা কেরানীগঞ্জে সমাবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জান দেব তবু জমি দেব না

জান দেব, তবু জমি দেব না—এমন স্লোগানে নিজেদের ক্ষোভ আর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন কেরানীগঞ্জের ১৬টি মৌজার লাখো বাসিন্দা। গতকাল তারা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন। এ সময় ভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে দল-মত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ। বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢলে বছিলা ব্রিজের পর থেকে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শেষে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বাপ-দাদার ভিটে-মাটি রক্ষায় আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেওয়ারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মানববন্ধনে উপস্থিত বক্তাদের পক্ষ থেকে। বিক্ষুব্ধরা বলেছেন, তাদের ভিটে-মাটি ও কৃষি জমি রাজউক অন্যায়ভাবে অধিগ্রহণ করে এমপিদের জন্য আবাসন প্রকল্প করতে চাইছে। সেই ভিটে-মাটির লোকের রক্তের শেষবিন্দু থাকতে তা হতে দেবে না। কারণ সেখানে তাদের ১৪ পুরুষের বসবাস। তা তারা কখনই ছাড়বেন না।

মানববন্ধনে একাত্মতা ঘোষণা করতে আসা কেরাণীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, এখানে প্রায় ৪০০ বছরের বসতি। এসব জমি অধিগ্রহণের নামে রাজউক করতে পারে না। দুর্নীতি আর অপকর্মের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটির পিয়ন পর্যন্ত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এখানে মন্ত্রী-এমপিদের প্লট দেওয়া হবে আর সাধারণ মানুষদের ভূমিহীন করে নিঃস্ব করে দেওয়া হবে তা মেনে নেওয়া হবে না। এই মাটিগুলোতে অনেকের কবর আছে এবং বাসিন্দাদের সম্পর্ক মাটির সঙ্গে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বছিলা ব্রিজ থেকে কলাতিয়া বাজার পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়কের দু-পাশে অবস্থান নেয় সর্বস্তরের মানুষ। লাখো মানুষের এই অবস্থান মানববন্ধনের পাশাপাশি চলে বিক্ষোভ-সমাবেশ। ১৬টি মৌজার বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিবাদ জানাতে পৃথক মানববন্ধন স্থলে যোগ দিতে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন তারা। কিছু কিছু মিছিল মোহাম্মদপুর বছিলা মোড় পর্যন্ত গিয়েও প্রতিবাদ জানাতে থাকে। নিজেদের ভিটে-মাটিতে কোনো আবাসন প্রকল্প হতে দেবেন না জানিয়ে স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে পড়েন নারী-পুরুষ-শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ। রাজউকের অধিগ্রহণের প্রস্তাবনায় যে ১৬টি মৌজার জমি নেওয়া হয়েছে সেখানে ২০ হাজার পরিবারের কয়েক লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে। আর রাজউক এসব ভূমি অধিগ্রহণ করলে এলাকার মানুষ তাদের বাপ-দাদার ভিটে-মাটি হারা হয়ে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়বে। এ আশঙ্কায় অস্তিত্ব রক্ষায় ওইসব এলাকার নারী, শিশু, প্রবীণ, ছাত্র-শিক্ষক, নেতা, সমাজপতিসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এক কাতারে নেমে আসেন রাস্তায়। তাদের দাবি একটাই—বাপ-দাদার ভিটে-মাটি হারাতে চান না। আর জমি রক্ষায় তারা জীবন দিতে প্রস্তুত বলেও স্লোগান তাদের। বিক্ষোভকালে ‘রাজউকের গালে গালে... মারো তালে তালে, রাজউকের কালো হাত ভেঙে দেব—দিতে হবে, বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছেড়ে যাব না, জান দেব—তবু জমি দেব না, রক্ত দেব—কিন্তু ১৪ পুরুষের ভিটে আবাসন হতে দেব না’ স্লোগান সংবলিত প্লেকার্ড প্রদর্শন করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে শেষ হয় বিক্ষোভ কর্মসূচি।  স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাজউক যে ১৬টি মৌজায় ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো হচ্ছে—আহাদীপুর, বাড়িলগাঁও, বেউলি কাশারিয়া, দেউতা, দক্ষিণ বাহেরচর, উত্তর বাহেরচর, বরইকান্দি, ছাগলাকান্দি, নজিপুর, মুন্সিনর্দা, তুরাগ, পাচুলি, ভতুর্তা, তারানগর, চুনারচর, কলাতিয়া। ওইসব মৌজার ভূমি অধিগ্রহণ করে আবাসন প্রকল্প করে মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও সমাজের বিশিষ্টদের আবারও প্লট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব এমপির ঢাকায় প্লট নেই মূলত তাদের চাপেই এই আবাসন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। তবে যেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে সেখানে প্রায় চার হাজার ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর মালিকরা যাতে প্রতিরোধ গড়তে না পারে সে জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দেড় গুণের জায়গায় তিন গুণ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করেছে রাজউক। এর আগে কেরানীগঞ্জে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে ঝিলমিল-২ আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়ায় পরে একই সড়কের ধলেশ্বরী সেতুসংলগ্ন এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয় আলোচনায় আসে। ওই এলাকা নিজেদের আওতাধীন না হওয়ায় সেখান থেকে সরে এসে কেরানীগঞ্জ-সাভার এলাকার ১৬টি মৌজাকে প্রকল্পের স্থান হিসেবে বেছে নেয় রাজউক। এই মৌজাগুলো বছিলা ব্রিজের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ঘাটারচর তিনরাস্তা মোড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী জানান, অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তে থাকা মৌজায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের বসবাস। এখানে আবাদি জমি ও বসতভিটা রয়েছে অসংখ্য। রাজউকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে এলাকার সাধারণ মানুষ বাপ-দাদার ভিটে-মাটিহারা হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে এর প্রতিবাদ জানাতে। অভিযোগ রয়েছে, প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় কিছু লোককে বিত্তশালী বানিয়ে দেয় রাজউক। ফলে রাজধানীর বিপুল জনগোষ্ঠী আবাসন সুবিধার বাইরেই থেকে যায়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই প্লটের পরিবর্তে স্বল্পমূল্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দের উদ্যোগ নেয় রাজউক। সেই লক্ষ্যে আবাসন প্রকল্পের পরিবর্তে উত্তরা, পূর্বাচল ও ঝিলমিলে এক লাখ ফ্ল্যাট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান যেসব এমপির রাজধানীতে প্লট নেই তাদের চাপেই ৬-৭ কিলোমিটার দূরে থাকা ওই জায়গাটি বেছে নেয় রাজউক।  সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের প্রকল্পপত্রে উল্লেখ করা ১৬টি মৌজায় মোট জমির পরিমাণ ২ হাজার ২৮৭ একর। এখানে ৮ হাজার প্লট তৈরি করা যেতে পারে। এসব এলাকায় সাড়ে ৩ হাজারের মতো অবকাঠামো রয়েছে। এসবের বেশির ভাগই একতলা-দোতলা পাকা ভবন।

রাজউকের বক্তব্য : এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সচিবের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,  পরিকল্পিত নগরায়ন ও আবাসন সমস্যা সমাধানে কেরাণীগঞ্জে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে প্রাথমিক সমীক্ষা যাচাইয়ের কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় কোনো বাড়িঘর কিংবা স্থাপনা নেই। শুধু বসতিহীন জায়গায় প্রকল্প গ্রহণের সমীক্ষা চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাস্তাঘাট ও নাগরিক সুবিধাসহ নানা উন্নয়ন হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর