মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাঙছে বাঁধ ডুবছে হাওর

কপাল পুড়ছে লাখ লাখ হতভাগ্যের

প্রতিদিন ডেস্ক

ভাঙছে বাঁধ ডুবছে হাওর

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে হাওরের বিস্তীর্ণ জমি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

হাওর এলাকায় ফিবছরের মতো এবারও ভাঙছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ-বেড়িবাঁধ আর এর সঙ্গে কপাল পুড়ছে খাদ্য উৎপাদক হিসেবে পরিচিত লাখ লাখ কৃষকের। সব হারিয়ে হতভাগ্য এসব মানুষরা এখন চোখের সামনে দেখছেন শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। কয়েকদিনে বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

সুনামগঞ্জ : একদিন আগেও দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল পোয়াতি ধান। চোখ যে দিকে যেত সে দিকেই ছিল সবুজের সমারোহ। কিন্তু সেখানে আজ থৈ থৈ করছে বানের পানি। ডুবে আছে এক ফসলি সুনামগঞ্জের লাখো মানুষের সারা বছরের জীবন-জীবিকার অবলম্বন বোরো ধান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও বেড়িবাঁধ ভেঙে ধারাবাহিকভাবে ডুবছে হাওরের পর হাওর। এমন অবস্থায় জেলার লাখ লাখ বোরো চাষির বিলাপে ভারী হয়ে উঠেছে হাওরের আকাশ বাতাস। চলতি মৌসুমে যে ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল, গত চারদিনের ধারাবাহিকতায় তার প্রায় ৬০ ভাগেরও বেশি ফসল এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, জেলার খাদ্যভাণ্ডার-খ্যাত সদর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখারহাওর, খরচারহাওর, কাংলারহাওর, জামালগঞ্জ উপজেলার হালিহাওর, দিরাই  উপজেলার বরামহাওর, ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল, ফাসুয়াহাওর, গুরমাহাওর, বোয়ালাহাওর, শালদিঘাহাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ারহাওরের বেশির ভাগ ধানই বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে। এদিকে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে গতকাল বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত হতভাগ্য মানুষরা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে শান্তিগঞ্জ এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা হাওরের ফসলরক্ষায় স্থায়ী সমাধান এবং সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গতএলাকা ঘোষণার দাবি জানান। পরে স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। অবরোধ চলার সময় কৃষকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন সুনামগঞ্জের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল আলম। অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে গেলে তিনি এর ঘটনার শিকার হন। অবরোধের কারণে সড়ক পথে আটকেপড়া যানবাহনের যাত্রীরা দারুণ ভোগান্তিতে পড়েন। রাস্তার দুপাশে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। একই দাবিতে এদিন বেলা ১১টায় মানববন্ধন করেন সচেতন হাওরবাসী নামের একটি সংগঠনও। এদিকে যেসব হাওর এখনো অক্ষত আছে সেগুলোকে রক্ষা করতে গতকালও স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত কাজ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা মানুষের পাশে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও এসে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের বাঁশ, বস্তা, দড়ি নৌকা ইত্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করছেন। কৃষকদের অভিযোগ, মেরামতের এই দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের হলেও ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বাঁধে তাদের দেখা যায়নি। স্থানীয়রা জানান, হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে জনপ্রতিনিধিরা মোটামুটি কাজ করলেও অনেক ঠিকাদার নামমাত্র কাজ করায় হাওরের বোরো ফসল প্রতি বছরই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এবারও অনেক হাওরের বেড়িবাঁধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োগ পাওয়া ঠিকাদাররা কোনো কাজই করেনি।  সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর জানায়, সুনামগঞ্জে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। যেখান থেকে ৮ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যার বাজার মূল্য ২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। বছরের উৎপাদিত এই একটিমাত্র ফসলের সঙ্গে জেলার ২৬ লাখ মানুষের ৮০ ভাগের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

নেত্রকোনা : পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ শেষ হওয়ার একদিন পরই গতকাল বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই হাওরের কাঁচা ধান। খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা উপজেলার বেশ কটি হাওর পুরোটাই চলে গেছে পানির নিচে। নতুন নতুন জায়গা দিয়েও ঢুকছে পানি। সাপমরা খালসহ বিভিন্ন সুইসগেটে বালির বস্তা ও বাঁশ দিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না পানির প্রবাহ। বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা ধান ডুবে যাওয়ায় অনেকে গরু নামিয়ে দিয়েছেন জমিতে। কেউ কেউ গো-খাদ্যের জন্য ধান কেটেও নিচ্ছেন। গত রবিবার ভোর রাতে চরহাইজদা বেড়িবাঁধের জালালের পয়েন্টে প্রায় ২০০ ফুট ভেঙে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীসহ কৃষকদের অভিযোগ, এ যাবৎকাল ধরে চরহাইজদা বাঁধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ সরকার বরাদ্দ দিয়েছে—তার যথাযথ ব্যবহার হলে পানি ঢোকার কথা নয়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, তারা যথাযথ কাজই করেছেন। বাঁধ ভাঙার কারণ প্রাকৃতিক। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলাম নাফিস বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় ১৬ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অসময়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের কৃষকের প্রায় ৮-১০ হাজার হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

মানববন্ধন : ‘নৌকায় ভোট দেয় হাওরবাসী, ধান দেয় হাওরবাসী, সুস্বাদু মাছ দেয় হাওরবাসী—অথচ বছরের পর বছর অকাল বন্যায় জলে ভাসি আমরা’ শীর্ষক স্লোগানে বাঁধ নিরাপত্তায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে গতকাল নেত্রকোনায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিকাল ৪টায় নেত্রকোনা পৌরসভার মোড়ে ‘আমরা হাওরবাসীর সন্তান’ ব্যানারে মদন মোহনগঞ্জ খালিয়াজুরীর হাওরবাসীর উদ্যোগে এ মানববন্ধন করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিকসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের (একাংশ) নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। 

হবিগঞ্জ : কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে ঢলের পানি নেমে আসায় হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের নিম্নাঞ্চলের ইরি-বোরো ধানের জমি তলিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বানিয়াচঙ্গ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নীচু এলাকার প্রায় ২০০ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে নদীগুলোতে পানি ও স্রোত বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাঁধগুলো রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বস্তা দিয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি বাঁধ এলাকায় পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া খাল ও নদীতে স্থানীয় কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করছেন। তবে পানি আরও বাড়লে বাঁধগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে বানিয়াচঙ্গ, আজমিরীগঞ্জ, লাখাইয়ের বেশির ভাগ বোরো জমি রয়েছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উজান থেকে আসা পানি প্রবাহিত হয়ে ধান গাছগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে আজমিরীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীসহ বানিয়াচঙ্গে কয়েকটি এলাকায় নদীর বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব বাঁধ ভেঙে গেলে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম জানান, হবিগঞ্জের ৪৫৪ কিলোটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে আজমিরীগঞ্জ এলাকা বতর্মানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আজমিরীগঞ্জ এলাকা দিয়ে বিপদসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কালনী, কুশিয়ারা নদীতেও পানি বাড়ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর