বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চারুকলায় বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন

মোস্তফা মতিহার

চারুকলায় বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন

‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ মর্মবাণী ধারণ করে ঐক্য ও অসাম্প্রদায়িকতার ডাক দিয়ে আসছে বাঙালির চিরগৌরবের পয়লা বৈশাখ। আর মাত্র এক সপ্তাহ পরই গোটা জাতি মেতে উঠবে এ উৎসবে। বৈশাখ বরণের মূল কর্মসূচি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। রমনার বটমূলে ছায়ানটের

প্রভাতি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এই শোভাযাত্রা গত বছর ‘ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি পেয়েছে; যা বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এ কারণে অন্যবারের তুলনায় এবারের শোভাযাত্রা নিয়ে চারুকলার শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তারা এ কর্মসূচিকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করতে লাগাতার কাজও করে চলেছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, আঁকিয়ে শিল্পীরা রং আর কাগজ নিয়ে ব্যস্ত। খোশ, পুতুল, মাটির সরা, মাটির ব্যাংক, টেপাপুতুল, পাখি, হাতপাখাসহ নানা উপকরণ তৈরি করছেন ১৮তম ও ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। সৃজন আর চিত্রণে দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। একদিকে তৈরি করছেন অন্যদিকে করছেন বিক্রিও। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’। এ আয়োজন সফল করার জন্য অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও চারুকলা অনুষদ কোনো স্পন্সর কোম্পানির দ্বারস্থ হয়নি বলে জানান বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। নিজস্বতা ও স্বকীয়তা বজায় রেখেই বাংলা সংস্কৃতির শৈল্পিক উপস্থাপনায় নিজেদের তৈরি শিল্পকর্ম ও চিত্রকর্ম বিক্রি করে তারা তহবিল গঠন করছেন। ফান্ড তৈরিতে সহপাঠীদের তৈরি শিল্পকর্ম ও চিত্রকর্ম বিক্রিতে ব্যস্ত দেখা গেছে অনুষদের অন্য শিক্ষার্থীদের। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার দুই আহ্বায়কের একজন ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ সিদ্দিকী নিটল বলেন, ‘ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জনের পর আমাদের দায়িত্ববোধ বেড়ে গেছে; যার কারণে আমরা এবারের আয়োজনকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করছি। আশা করছি এবার সর্বাধিকসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ঘটবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কোম্পানিই এই আয়োজনে স্পন্সর হতে চেয়েছে, কিন্তু এতে আমাদের নিজস্বতা ক্ষুণ্ন হবে। আমরা চাই না বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের এই সংস্কৃতিতে করপোরেট কালচারের অনুপ্রবেশ ঘটুক। বাণিজ্যের কারণে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা কোনো স্পন্সর নিই না; যার কারণে আমরা নিজেরাই মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ তৈরি করছি, আর বিক্রি করে তহবিল গঠন করছি।’ তিনি জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাত কর্মীরা কাজ করছেন। আর বিক্রি করছেন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। ‘তিনটি গাছের মাঝে একটি সূর্য থাকবে আর সেই সূর্য থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে’ প্রাথমিকভাবে এবারের মূল প্রতীক এমনই থাকছে। সূর্যের মুখচ্ছবির মাধ্যমে পেছনের অন্ধকারকে পেছনে রেখে মঙ্গলালোকের দিকে ধাবিত হওয়ার বিষয়টি এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হচ্ছে। ওরিয়েন্টাল আর্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম জানান, এরই মধ্যে তাদের ৫০% কাজ শেষ হয়েছে। চৈত্রসংক্রান্তিতে কাজ শেষ করা হবে। বিগত বছরের প্রতীকের ডিজাইনে নতুনত্ব এনে এ বছর সেগুলোকে নতুন করে তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে সূচনা বছর ১৯৮৯ সালের কালো হাতের প্রতীকটিকে এবার নতুনভাবে উপস্থাপন করা হবে। বাঁশের চটা বেঁধে তৈরি বাঘ, হাঁস, বিড়াল, শখের হাঁড়ি, শিশু হরিণ, পেঁচা, কাগুজে বাঘ ইত্যাদি অনুষঙ্গ বরাবরের মতো থাকবে। বিক্রিতে ব্যস্ত মৃিশল্প বিভগের সোহান জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রার ফান্ড তৈরিতে জনসাধারণের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মিলছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধনে বাঁধতে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। কারণ ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজের স্বীকৃতি অর্জনের পর এটি এখন বিশ্বসংস্কৃতির ধারক-বাহকদের কাছেও ভিন্ন ধরনের আবেদন সৃষ্টি করেছে। দেখা গেছে, জনসাধারণের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছেন বলে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার তত্ত্বাবধানে থাকা চারুকলার ১৮ ও ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা। তারা বলছেন, যেভাবে জনসাধারণ এগিয়ে আসছে তাতে অচিরেই এ উৎসব দেশের সব উৎসবকে ছাড়িয়ে যাবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার তহবিল গঠনে বিক্রি করার জন্য শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে পাখির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ থেকে ৮০০, সরা ২৫০ থেকে ৬০০, জল রঙে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম ২০০০ থেকে ১০,০০০ এবং বিভিন্ন মুখোশ ৩০০ থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া হাতপাখা, বিভিন্ন শো-পিসও বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে; যার দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। পয়লা বৈশাখ ১৪২৪-কে স্বাগত ও ১৪২৩-কে বিদায় জানানোর লক্ষ্যে ১৩ এপ্রিল বিকালে চারুকলায় থাকছে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। এর তত্ত্বাবধানে থাকবেন চারুকলা অনুষদের ১৮ ও ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ খবর