সরকারি হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য, লাইসেন্সবিহীন প্রাইভেট ক্লিনিক, ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কবিরাজি ঝাড়ফুঁক ও হারবালের রমরমা ব্যবসার জোয়ারে চাপা পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানীর আনাচকানাচে চিকিৎসার নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন রক্তচোষা ব্যবসায়ীরা। হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি, ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে নিয়মিত, আছে চিকিৎসক, নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী, শুধু নেই কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যর্থতার কারণে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ লোক বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারের অদক্ষতা, অবহেলা, উদাসীনতার সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা চালাচ্ছেন সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, সরকারি বৈধ অনুমোদন নিয়ে সারা দেশে ২ হাজার ৭১৮টি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ৪ হাজার ৫৯৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। তবে অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শুধু রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ২০ হাজারের বেশি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার লাইসেন্স চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রাথমিক আবেদনপত্র পাঠালেও আর কোনো যোগাযোগ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরে।
লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার : রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের আনাচকানাচে গড়ে উঠেছে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত চলছে রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়। চিকিৎসাসেবার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এসব ভূঁইফোড় ক্লিনিক ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। আর এদের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এসব ক্লিনিকে অপারেশন, চেকআপ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনোটাতেই দেওয়া নেই অর্থের পরিমাণ। আর এ সুযোগে যে যেমন পারছেন রোগীদের পকেট কেটে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন। সাধারণ রোগের জন্যও চিকিৎসকেরা বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে রোগীদের পাঠাচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখান থেকে তারা গুনছেন কমিশনের পয়সা। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি হাসপাতাল নগণ্য। এজন্য মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে ক্লিনিকে যায়। কিন্তু চিকিৎসাসেবার আদর্শগত জায়গা ভুলে গিয়ে ব্যবসা খুলে বসলে তা মেনে নেওয়া যায় না।ভুয়া চিকিৎসকের দাপট : মানুষের রোগকে পুঁজি করে গ্রামেগঞ্জে কবিরাজ আর ভুয়া চিকিৎসকরা গড়ে তুলছেন ঝাড়ফুঁক ও অপচিকিৎসার রমরমা ব্যবসা। এরা তাবিজ-কবজের মাধ্যমে সব রোগের চিকিৎসা দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে করে চলেছেন প্রতারণা। ক্যান্সার চিকিৎসা, জন্ডিস সারানো বা চোখের চিকিৎসার নামে মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে রেখে চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগী মেরে ফেলছেন তারা। এ ছাড়া প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতেও বিশেষজ্ঞ ভুয়া চিকিৎসকের অভাব নেই। ভুয়া চিকিৎসকরা অর্থের জন্য রোগীর দেহে স্পর্শকাতর অস্ত্রোপচার করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। জীবন বাঁচানোর নামে রোগীর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছেন তারা। এ দেশের প্রাইভেট মেডিকেলগুলোর অনেকেরই নেই রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএমডিসির ওয়েবসাইটে তাদের তালিকা দেওয়া আছে। যে-কেউ কোনো চিকিৎসককে সন্দেহ হলে তার রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা তা দেখে নিতে পারবেন। ভুয়া চিকিৎসক শনাক্ত করতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। নয় তো এদের হাতে ঘটে যেতে পারে জীবনহানি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল পরিদর্শন বিভাগের নজরদারি আরও বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি : হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় নকল, ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু অসাধু ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসক এসব ওষুধ বিপণনকারীদের প্রলোভনে পড়ে রোগীদের যাচ্ছেতাই ওষুধ লিখে দিচ্ছেন। রোগীদের হাতে অপ্রয়োজনে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও অ্যান্টিবায়োটিক। ২০১৪ সালের টিআইবির স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন নিচ্ছেন। আর দালালরা নিচ্ছেন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা এতটাই বেহাল যে একজন চিকিৎসকের বিপক্ষে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা ৩ হাজার ২৯৭ জন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাত হওয়ার কথা ১ : ৬০০। এসব ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান খান বলেন, স্বাস্থ্যসেবা দিতে এসে ব্যবসার মনোভাব থাকলে চলবে না। যারা স্বাস্থ্যকে পুঁজি করে মানুষকে জিম্মি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।