শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

জিন্নাতুন নূর

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব বেশি দিনের না হলেও সংশ্লিষ্টরা আসছে দিনে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে ‘আশার আলো’ হিসেবে দেখছেন। শুধু শহর নয়, দুর্গম পাহাড় ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলও নবায়নযোগ্য জ্বালানির আলোয় আলোকিত হচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপন, সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সৌরপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এবং গ্রাম ও মফস্বলের যেসব এলাকায় লোডশেডিংয়ের কারণে জনগণের দুর্ভোগ বেশি সেখানেও এখন  বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এখন ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে আর বর্তমানে দেশে ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া সোলার রুফটপ, সোলার ইরিগেশন, সোলার মিনি গ্রিড, সোলার চার্জিং স্টেশন এবং বায়ুগ্যাস প্রসারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনাময় উৎসকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। এর অংশ হিসেবে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ৭০০ মেগাওয়াট এবং বায়ু বিদ্যুৎ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির মাধ্যমে এসব বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ এরই মধ্যে শুরু করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে আমাদের লক্ষ্য মোট বিদ্যুতের ৫ শতাংশ উৎপাদন করা। পরে আরও ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ এ খাত থেকে উৎপাদন করার পরিকল্পনা আছে। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এখন ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। হাইড্রো, সোলার ও বায়ু— এই তিন পদ্ধতিতে আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করার পরিকল্পনা করেছি। বর্তমানে সে অনুপাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ খাত থেকে দুই হজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ইচ্ছা থাকলেও এ জন্য যে স্থান প্রয়োজন তা নিয়েই সমস্যা। তবে এ খাতে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা করছি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এসব এলাকায় ব্যবহারকারীরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়াটের সৌর বিদ্যুতের প্যানেল ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া দেশের উপকূলীয় এলাকাতেও সৌর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এসব এলাকায় সেচকাজের জন্য সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহূত হচ্ছে। এমনকি খাদ্য গুদামেও ব্যবহার হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ। বগুড়ার সান্তাহারে দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ সুবিধাসহ বহুতল খাদ্য গুদামের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে ইজিবাইক ব্যাটারি রিচার্জ করতে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে সোলার চার্জিং স্টেশন করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জের একটি স্টেশনের উদ্বোধনও করা হয়েছে। আরও তিনটি স্টেশন পরীক্ষামূলকভাবে চালানো শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় থাকা সংস্থা বা কোম্পানি এসব চার্জিং স্টেশন স্থাপন করছে। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লি. (ডেসকো) ঢাকায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে একটি সোলার চার্জিং স্টেশন করবে। সোলার মডিউল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এসএমএমবি)-এর সূত্রে, দেশে ১৫০০ কোটি টাকার গ্রিন প্রোডাক্ট ও পণ্যের চাহিদা আছে। দেশে প্রতি মাসে স্থাপন করা হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার ‘সোলার হোম সিস্টেম’। প্রথমবারের মতো দেশে তৈরি হচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের সৌর প্যানেল (থিন ফিল্ম সোলার সেল)। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই সেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আশা করা হচ্ছে এটি বাণিজ্যিকভাবে দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনের উপযোগী হবে। এতে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ কমবে অন্তত ৪০ শতাংশ। পাশাপাশি ব্যাটারিবিহীন প্রযুক্তিতে সৌর সিস্টেম স্থাপনের খরচও অর্ধেকে নেমে আসবে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে মেঘলা দিনেও এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। গবেষক দলের প্রধান ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ শাহরিয়ার বাসার জানান, দেশে এই সেল উৎপাদন সম্ভব হলে কম খরচে মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া যাবে। সূত্র জানায়, দেশের তিন দুর্গম পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। জাতীয় গ্রিডের জন্য সোলারভিত্তিক বিদ্যুতের ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্য সরকার সম্প্রতি একটি কর্মসূচি শুরু করেছে। এতে বেসরকারি খাতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাগেরহাট, জামালপুর, রাঙ্গামাটি, পঞ্চগড়, কক্সবাজার, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জে সাতটি সোলার পার্ক এবং পটুয়াখালীতে বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার হাওরে ৩২ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বায়ু বিদ্যুৎ দেশে উৎপাদন সম্ভব হবে। এ ছাড়াও টেকনাফে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরপার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এর বাইরে বগুড়ায় ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সোলার পার্ক, কুড়িগ্রামে ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক ও রংপুরে ৫৫ মেগাওয়াটের সোলার পার্ক স্থাপনসহ আরও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর