রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাস-ট্রেন চালু খুলনা-কলকাতায়

বিরল সীমান্ত দিয়ে যাচ্ছে পণ্য

সামছুজ্জামান শাহীন, সাইফুল ইসলাম ও বকুল মাহবুব, বেনাপোল (যশোর) থেকে

বাস-ট্রেন চালু খুলনা-কলকাতায়

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা ৫৫ মিনিট। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউস থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খুলনা-কলকাতা দ্বিতীয় মৈত্রী ট্রেনের শুভ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই সময়ে বেনাপোল স্থলবন্দরে দাঁড়িয়ে হাতে সবুজ পতাকা নাড়লেন রেলমন্ত্রী ম?ুজিবুল হক। ততক্ষণে চাকা ঘুরতে শুরু করেছে লাল-সবুজের ছোপে সুসজ্জিত চকচকে সাদা ট্রেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেনের নেতৃত্বে ৩৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মৈত্রী রেলটি নিয়ে বেনাপোল স্টেশন ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে ভারতে পেট্রাপোলে প্রবেশ করেন। এর মধ্য দিয়েই চালু হলো দীর্ঘ প্রত্যাশিত খুলনা-কলকাতা আন্তদেশীয় রেল সার্ভিস। এদিকে একই সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কলকাতা থেকে যশোর ও খুলনা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বাস সার্ভিসেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকা-কলকাতা রুটে প্রথমবারের মতো মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ঐতিহাসিক এই যাত্রার মধ্য দিয়ে যোগাযোগ খাতেও দুই দেশের সম্পর্ক আরও একধাপ এগিয়ে গেল। রেলমন্ত্রী ম?ুজিবুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক প্রয়াস। এতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের জনগণই উপকৃত হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক উন্নয়নে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা অবদান রাখবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেনাপোল রেলস্টেশনে ভিডিও কনফারেন্স স্থলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ মিজানুর রহমানসহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।  গতকাল সকাল ৮টায় খুলনা থেকে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হয় দ্বিতীয় মৈত্রী ট্রেন। আগে থেকেই ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৫টি বগিকে ধোয়ামোছা করে রঙিন কাপড় ও ফুল দিয়ে ঐতিহাসিক যাত্রার জন্য প্রস্তুত রাখে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, খুলনা ও কলকাতা রেলস্টেশনে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী ট্রেন চালানোর যাবতীয় অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে। বেনাপোল এবং ওপারের পেট্রাপোলে নতুন করে পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। তবে পরীক্ষামূলক উদ্বোধন হলেও আনুষঙ্গিক কাজের অসম্পূর্ণতার কারণে বাণিজ্যিকভাবে নিয়মিত চালু হতে আরও কিছুদিন লাগবে।

প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘ট্রেন সার্ভিসটি আবারও চালু হওয়ায় যাতায়াতের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। একই সঙ্গে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃৎতিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় হবে।’ খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘খুলনা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিসের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। এর ফলে মংলাবন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।’

জানা যায়, উদ্বোধনের পর থেকে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি সপ্তাহে এক দিন চলাচল করবে। পরে ট্রিপ বাড়ানো হবে। তিন ঘণ্টার মধ্যে ব্যবসায়ী, পর্যটক, রোগী কলকাতায় পৌঁছাতে পারবে। দুই দেশের মানুষ যাতে আরও অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে ও নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করতে পারে সে লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কলকাতা প্রতিনিধি দীপক দেবনাথ জানান, কলকাতা-খুলনা-ঢাকা (আনুমানিক ৪০৯ কিলোমিটার) বাস যাত্রারও আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গের সচিবালয় নবান্ন থেকে পতাকা নাড়িয়ে এই বাস যাত্রার শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সোমবার, বুধবার, শুক্রবার— সপ্তাহের এই তিন দিন বাস চলাচল করবে কলকাতা থেকে। অন্যদিকে মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ও শনিবার ঢাকা থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছাড়বে এই বাস। ভারতীয় দিকে এই বাস চালানোর দায়িত্বে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন দফতর ও এবং বাংলাদেশ দিকে থাকবে বিআরটিসি। এর পাশাপাশি দুই দেশের রেল কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে রাধিকাপুর-বিরল ট্রেন যাত্রারও আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।

এদিকে হায়দরাবাদ হাউস থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন ‘ভারত-বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি বাড়ানোর লক্ষ্যে একাধিক নতুন লিঙ্ক স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে বাস ও ট্রেন পথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি জলপথেও সংযোগ স্থাপনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দিনাজপুর প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম জানান, সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারে রেলপথে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের চুক্তি অনুযায়ী দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে ডুয়েল গেজ রেলপথে আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে রেলপথে আবার শুরু হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পণ্য  আমদানি-রপ্তানি। এই রেলপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানি একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাবে অন্যদিকে কর্মসংস্থানসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। দিনাজপুর অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে। গতকাল দুপুর ১টার দিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে বসে রাধিকাপুর স্টেশনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ওই রুট যৌথভাবে উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে দুপুর ২টার দিকে দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে ৪২টি তেলের ওয়াগনে ইন্ডিয়ান হাইস্পিড ডিজেল (জ্বালানি) নিয়ে পণ্যবাহী একটি ট্রেন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিমানগর তেল রিফাইনারি ডিপো থেকে এই ট্রেনটি যাত্রা করে। ট্রেনটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের দিনাজপুরের পার্বতীপুর তেল ডিপো পর্যন্ত যায়। এই পণ্যবাহী ট্রেনে মোট ২ হাজার ২০০ মেট্রিক টন জ্বালানি ছিল। পরে ট্রেনটি বিরল রেলস্টেশনে গিয়ে যাত্রাবিরতি দেয়। সেখানে মালামালগুলো পরীক্ষা করে ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ খবর