রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

হাসপাতালে আইসিইউ বাণিজ্য

লাশের চিকিৎসা করেও নেওয়া হয় টাকা

মাহবুব মমতাজী

নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এখন আর মুমূর্ষু রোগীর সুচিকিৎসার জন্য ব্যবহার হচ্ছে না। বেসরকারি কিছু হাসপাতাল একে অবৈধ বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরা এখন আইসিইউ আতঙ্কে ভুগছেন। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, কী কারণে রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হলো- চিকিৎসকরা তা কখনই স্পষ্ট করেন না। রোগীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, কী অবস্থায় কেমন আছেন, তাও জানানো হয় না। কিন্তু হাসপাতাল ছাড়ার সময় তাদের মোটা অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিলের টাকা না দিলে তারা রোগীকে আটকে রাখেন। কোনো কোনো হাসপাতালে লাশও আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধা অপর্যাপ্ত। অনেক সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ঠিকমতো কাজও করে না। এর মধ্যে ঢাকার পঙ্গু ও পুনর্বাসন হাসপাতাল (নিটোর) অন্যতম। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল আইসিইউ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হাসপাতাল মালিক-চিকিৎসকদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বড় সিন্ডিকেট এই   বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। বেসরকারি হাসপাতালের দালালরা ঘুরে বেড়ায় সরকারি হাসপাতালে। ওই সব দালালের মাধ্যমে রোগী এনে চিকিৎসার নামে জিম্মি করা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধার জন্য যে পরিমাণ বাজেট দরকার, তার আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকগুলোর আইসিইউ খুবই নিম্নমানের। যেখানে সাধারণদের ভুল-ভাল বুঝিয়ে ভর্তি করা হয় এবং তাদের ঠকিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এসব প্রতিরোধে সরকারের একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা দরকার। একই সঙ্গে পেশাজীবীদেরও সোচ্চার হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. ফেরদৌসী হক বলেন, আইসিইউ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও আইসিইউ সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। লাশ আটকে রেখে টাকা আদায়ের ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে রাজধানীতেই। তিন দিন আগে মারা গেলেও শুধু টাকার লোভে এক স্কুলছাত্রী আইভীর লাশ আটকে রেখে চিকিৎসা করানোর অভিযোগ উঠে মহাখালীর মেট্রোপলিটন মেডিকেল  সেন্টার নামে একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। স্বজনদের অভিযোগ, আইসিইউতে রেখে মেয়ে বেঁচে আছে দাবি করে স্বজনদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও কয়েকজন চিকিৎসক। আইভীর মা মোসা. হাসি বলেন, ১৮ মার্চ সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়ার পর আইভীকে ভর্তি করা হয় মহাখালীর মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে। সেখানে আইসিইউতে রেখে ১৫ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পরও অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় গত রবিবার রাতে আইভীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। তখনই মেট্রোপলিটন হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে অন্য চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে স্বজনরা দাবি করেন, আইভী তিন দিন আগেই মারা গিয়েছিল। অভিযোগে আরও জানা গেছে, ৪৫ বছর বয়সী জাহানারা বেগম গত ১৬ জানুয়ারি আগুনে দগ্ধ হয়ে ভর্তি হন কক্সবাজার সরকারি হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে ২৮ জানুয়ারি স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। আর ১০ ফেব্রুয়ারি তাকে নেওয়া হয় আইসিইউতে। সেখানে শয্যার ভাড়া ছিল নামমাত্র। উন্নত চিকিৎসার দোহাই দিয়ে বারডেমের চিকিৎসক ডা. ফয়েজ আহমেদের পরামর্শে পরবর্তীতে তাকে রাজধানীর পান্থপথে ধানমন্ডি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে ওষুধসহ প্রতিদিন ভাড়া পরিশোধ করতে হতো ৩৫ হাজার টাকা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি পরিস্থিতি গুরুতর জানিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলে পরদিন দুপুরে মৃত্যু হয় জাহানারার। তিনি ডা. ওমর ফারুকের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ২৮ মার্চ কুমিল্লায় ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ব্রেইন স্ট্রোক করেন। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে। সেখানে খরচ অনেক হওয়ায় ৩১ মার্চ অনেক তদবির করে স্থানান্তর করা হয় ঢামেকের আইসিইউতে। ৬৫ বছর বয়সী ফুলবাসীকে গত শুক্রবার ঝালকাঠি থেকে প্রথমে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর দুই দিন পরই নানা তদবিরে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা বলেছেন হার্টের বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে ফুলবাসীর। মাদারীপুরের লুত্ফর রহমান নামে এক ব্যক্তির বাবা স্ট্রোক করে ভর্তি হয়েছেন ঢামেক হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বলেছেন- অবস্থা খুবই খারাপ, যত দ্রুত সম্ভব আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হবে। গত ৫ দিন ধরে অপেক্ষার পরও তিনি পাচ্ছেন না আইসিইউর কোনো শয্যা। এর জন্য তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেও একাধিকবার দৌড়ঝাঁপ করেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি তার। ঢামেক ছাড়াও অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে তিনি খুঁজেছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের একটি মাত্র শয্যা। লুত্ফরের ভাষ্য, আমাদের কোনো সাধ্য নেই বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করানোর। কারণ সেখানকার খরচ অনেক। যে টাকা জোগাড় করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের মাত্র ৭টিতে ৮০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ সুবিধা চালু আছে। এর মধ্যে রাজধানীর তিনটি হাসপাতালে আছে আইসিইউ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহেও আছে এ সুবিধা। আন্তর্জাতিক চিকিৎসাসেবা মানদণ্ড অনুযায়ী- প্রতি ২০টি সাধারণ শয্যার বিপরীতে একটি করে আইসিইউ শয্যা থাকার কথা। অর্থাৎ কোনো হাসপাতালে ১০০টি শয্যা থাকলে ৫টি শয্যা রাখতে হবে আইসিইউর জন্য। আর ঢামেক হাসপাতালে আছে ২ হাজার ৬০০টি শয্যা। সেখানে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ৩২০০-৩৫০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। কিন্তু সেখানকার আইসিইউর শয্যা খুবই অপর্যাপ্ত। আইসিইউ শয্যা আছে মাত্র ৩৫টি। এর মধ্যে বার্ন ইউনিটের জন্য বরাদ্দ রাখা আছে ১০টি। সেখানে আগুনে পোড়া গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে আছে ৮টি। এর ৫টিতে ভেন্ডিলেশন নষ্ট। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে ১০টি। তবে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ১১১টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর সুবিধা অনেক বেশি থাকলেও তা অনেক ব্যয়বহুল। যেখানে প্রতি শয্যার জন্য চার্জ নেওয়া হয় ১৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের অসংখ্য মানুষ নিজের জমি বিক্রি করে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করে তাদের স্বজনদের চিকিৎসার খরচ মিটিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বাণিজ্য চলে একটি সিন্ডিকেট দ্বারা। যারা সব বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারি হাসপাতালের অনেক রোগীকে বাগিয়ে নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করারও নজির আছে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। আর এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সরকারি হাসপাতালগুলোর কিছু অসাধু চিকিৎসক, ব্রাদার, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ড বয় এমনকি অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও। বেসরকারি হাসপাতালে রোগী বাগানো বাবদ কমিশনও আছে তাদের জন্য। মৃত রোগীকে জীবিত বলে আইসিইউতে রেখে পরবর্তীতে ধরা হয় মোটা অঙ্কের চার্জ। সূত্র জানায়, আইসিইউতে কয়েক ঘণ্টা রাখার পর টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত লাশ হস্তান্তর করা হয় না। এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। গত বছরের নভেম্বরে ওই হাসপাতালে ১৬ মাস বয়সী একটি শিশু মারা যাওয়ার পর লাশটি আইসিইউতেই রাখা হয়। বিনিময়ে শিশুটির অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। এ সময় অসৎ উপায়ে বাণিজ্য এবং নানা অনিয়মের অভিযোগে র‍্যাবের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ওই হাসপাতালকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে র‍্যাবের আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, আমরা ওই এলাকায় অভিযান শেষে ফিরে আসছিলাম। এমন সময় মারা যাওয়া বাচ্চাটির বাবা আমাদের কাছে এসে জানতে চান যে- তার ছেলের চিকিৎসার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে। তাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে- মেডিকেল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে তার ছেলেকে চিকিৎসা দেওয়া হবে, যে জন্য অনেক টাকাও তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। পরে আমরা বাচ্চাটিকে আইসিইউ থেকে নয় বরং অন্য একটি রুম থেকে উদ্ধার করি। পরে জানতে পারি ওই বাচ্চাটি মারা গিয়েছিল ঠিক আগের দিন।

সর্বশেষ খবর