রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরগরম রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী

বৈশাখী আমেজ

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও জাহাঙ্গীর আলম হানিফ, রূপগঞ্জ থেকে ফিরে

সরগরম রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী

লাল রেশমি সুতায় গোল্ডেন জরি আর শিকড় কেচি পাড়ে জামদানি শাড়ির নকশা তুলছিলেন ফরিদুর রহমান। সামনে পয়লা বৈশাখ। এর মধ্যে শেষ করতে হবে হাতে নেওয়া অর্ডার। তাই দম ফেলার ফুরসত নেই তার। শুধু ফরিদই নন, পয়লা বৈশাখের আমেজে এখন জমজমাট রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী। জামদানির আঁতুড়ঘর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। তাই বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখে ষোল আনা বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহ থাকে বাঙালি নারীর হৃদয়ে। এই আগ্রহের জায়গা থেকে আগেই নিজের পছন্দমতো অর্ডার করেন তারা। এজন্য প্রত্যেক কারিগরের হাতেই রয়েছে নতুন শাড়ির কাজ। নাওয়া-খাওয়া ভুলে একমনে তাঁতে শাড়ির নকশা তুলছেন কারিগররা। সরেজমিন রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি তাঁতেই চলছে জামদানি তৈরির কাজ। কেউ রেশমি সুতায় তুলছেন হাফসিল্কের কাজ, কেউ শাড়ি তৈরি করছেন কটনের সুতায় আবার কেউ নাইলনের সুতায় তুলছেন জামদানি নকশা। জামদানি কারিগর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মার্চের শুরু থেকেই আমরা পুরোদমে কাজ করছি। বছরের এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি অর্ডার পাই। তাই এই সময় পুরোটা কাজ করার জন্য আগে থেকে কারিগরদের অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখি।’ শাড়ির বেচাকেনা সম্পর্কে তাঁত মালিক রইস আলী বলেন, ‘আগে পয়লা বৈশাখে লাল, সাদা, সবুজ শাড়ির অর্ডার বেশি পেতাম। কিন্তু এখন নীল, বেগুনি, গোলাপি, সোনালিসহ বিভিন্ন রঙের জামদানি শাড়ির অর্ডার পাই। এ বছর আমার তাঁতে বেশকিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অর্ডারি শাড়ির কাজ চলছে। এই শাড়ি তৈরিতে আমার খরচ পড়বে প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর এর ওপর কিছু হালকা কাজ বসিয়ে ঢাকার শপিং মলগুলোয় বিক্রি হবে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়।’ এ বছর পয়লা বৈশাখে জামদানি পল্লীতে সর্বোচ্চ কত দামের শাড়ি তৈরি হচ্ছে— খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, আনোয়ার আলীর তাঁতে তৈরি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা মূল্যের শাড়ি। নারায়ণগঞ্জের এক ব্যবসায়ী এই শাড়ির অর্ডার দিয়েছেন। এ বছরের বেচাকেনা কেমন হচ্ছে— জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, ‘সারা বছর আমাদের তেমন একটা কাজ থাকে না। তবে পয়লা বৈশাখের আগে অনেক অর্ডার আসে। এ বছরও ভালোই অর্ডার পেয়েছি।’ তবে ‘লাভের টাকা হাতছাড়া হয়ে যায়’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমরা শাড়ি বানাই ১০ হাজার টাকায়, মানুষ শপিং মল থেকে কেনে ২৫ হাজার টাকায়। এই বিশাল অঙ্কের টাকার মধ্যে মোটা দাগের লাভ করেন ব্যাপারী ও মহাজনেরা। শরীরের ঘাম না ঝরিয়ে, কোনো বিনিয়োগ না করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাভের ভাগ। তবে যে ক্রেতারা জামদানি সম্পর্কে জানেন তারা না ঠকে সরাসরি আমাদের এখানেই আসেন।’ তাঁতি পরিবারের সবাই ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্ডারের কাজ নিয়ে। কেউ সুতা রং করছেন, কেউ শাড়ি বুনছেন, কেউ আবার শাড়ি তৈরির পর বাঁশের আড়ে ঝুলিয়ে মাড় দিয়ে রোদে শুকাচ্ছেন। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে জামদানি পল্লীর ভিতরে গড়ে ওঠা দোকানগুলোও সেজেছে নতুন সাজে। দোকানের ভিতরের থরে থরে সাজানো রকমারি জামদানি। মাঝে মাঝে ক্রেতারা আসছেন কিনতে। রাজধানীর রামপুরা থেকে জামদানি পল্লীতে শাড়ি কিনতে গিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তা রোকসানা বেগম। তিনি বলেন, ‘এবার পয়লা বৈশাখে আমি লাল সবুজ জামদানি পরব বলে ঠিক করেছি। তাই যেখান থেকে তৈরি হয় সেখানে এসেছি জামদানি কিনতে। রাজধানীর আলোঝলমলে শপিং মলে জিনিসের দামের সঙ্গে মানের মিল খুঁজে পাই না। কিন্তু এখানে অল্প দামে মানসম্মত জামদানি কিনতে পারি বলে চলে আসি।’ পল্লীবাসীর ভাষ্য, জামদানি পল্লীতে কালেভদ্রে ক্রেতা এলে তাঁতিদের তেমন কোনো লাভ হয় না। তাই রূপগঞ্জের জামদানিকে তুলে ধরতে এখানে বাজার গড়ে তোলা প্রয়োজন; যাতে ক্রেতারা সরাসরি তাঁতিদের কাছে থেকে নিজের পছন্দমতো শাড়ি বুঝে নিতে পারেন। আর এর মধ্য দিয়ে জামদানি কারিগররাও পাবেন তাদের ন্যায্য মূল্য। এর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে জামদানিশিল্পে।

সর্বশেষ খবর