সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
অস্তিত্ব সংকটে তাঁতিরা

রূপগঞ্জ জামদানি পল্লীর অর্ধেকই বেহাত

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও জাহাঙ্গীর আলম হানিফ, রূপগঞ্জ থেকে ফিরে

রূপগঞ্জ জামদানি পল্লীর অর্ধেকই বেহাত

রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে সময়ের ঢেউয়ে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জামদানি পল্লী। দুই পাশে সারি সারি ঘর। কেউ তাঁতে বসিয়েছেন রেশমি জামদানি, কেউ আবার সুতি সুতায় জুড়ছেন নকশা। শুধু রূপগঞ্জে জামদানি তাঁতিদের বাসস্থান এবং এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার তৈরি করেছিল জামদানি পল্লী। কিন্তু এই পল্লীর ৫০ ভাগ প্লটই এখন আর তাঁতিদের দখলে নেই। বেহাত হয়ে চলে গেছে মুদি দোকানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীদের দখলে। সরেজমিনে দেখা গেছে, জামদানি পল্লীতে ঢুকতেই দু-একটি জামদানি শাড়ি ঝোলানো ছোট ছোট দোকান। পাশের গলি রাস্তা দিয়ে ভিতরে হাতের ডানে আকরাম জামদানি কারখানা। আটটি তাঁতে বিভিন্ন নকশার শাড়ি তৈরি করছেন কারিগররা। আর প্রত্যেক কারিগরের পাশে বসে মাকু (সুতা পেঁচানোর দণ্ড) ঘুরিয়ে দিচ্ছেন সাগরেদরা। গোলাপি হাফ সিল্ক সুতায় সুরমাদানি নকশা তুলছেন কারিগর মিনহাজ। এই শাড়ির দাম কত পড়বে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এই শাড়ির সব খরচ এবং লাভ রেখে আমরা বিক্রি করব আট হাজার টাকায়। কিন্তু ব্যাপারীদের হাত ঘুরে দোকানে পৌঁছালে এই শাড়ির দাম হবে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। তাঁতির বেচা দাম আর ক্রেতার কেনা দামের মধ্যকার লাভের টাকা যায় ব্যাপারির হাতে। কোনো ধরনের বিনিয়োগ এবং পরিশ্রম না করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তাই তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি শাড়ি কেনার সুবিধা তৈরিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তারা। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে পাল্লা এবং বাজার ওঠানামার জন্য অনেক তাঁতিই হয়েছেন নিঃস্ব। আর তাঁতিদের এই দৈন্যতার সুযোগ নিয়ে তাদের নামে বরাদ্দ করা প্লট কিনে নিয়েছেন অন্য পেশাজীবীরা। তাঁতি পল্লীর অর্ধেক জুড়ে গড়ে উঠেছে দালান-কোঠা। তারা অন্য পেশাজীবী। তাঁতিরা অভিযোগ করে বলেন, ১৯৯১ সালে সরকার রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামদানি তাঁতিদের এক জায়গায় আনতে তৈরি করেছিল তাঁতি পল্লী। তাঁতিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকার নিয়ম করেছিল তাঁতি ছাড়া কেউ এই প্লট বরাদ্দ পাবে না। এই প্লটে গড়ে ওঠা বাড়ির প্রত্যেকটিতেই তাঁত থাকতে হবে। মালিক যদি নিজে তাঁতি নাও হন তবে তাঁত তৈরি করে ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে তাঁতি পল্লীর ৫০ ভাগ বাড়িতেই তাঁতের ছিটাফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই তাঁতি পল্লীতে আছেন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী আবার চাকরিজীবীরাও। এ সময় জামদানি তাঁতি রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জামদানি শাড়ি তৈরি শিখতে এই পল্লীতে আসে তরুণেরা। প্রায় দুই বছর সাগরেদ অর্থাৎ শিক্ষানবিস থেকে প্রায় অবৈতনিক বা অল্প বেতনে কাজ শিখে কারিগর হয় তারা। কিন্তু প্লটের অভাবে কাজ শিখে এই পল্লীতে থাকার বা নতুন তাঁত তৈরি করতে পারেন না তারা। কারণ তাঁতিদের বরাদ্দ করা জায়গা আস্তে আস্তে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। আর এই কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে জামদানি শিল্প। পল্লীর আছিয়া বেগম বলেন, আমরা পারিবারিকভাবে জামদানি সুতা রং করি এবং চরকায় সুতা কাটি। আমার বড় ছেলে কয়েক বছর মানুষের তাঁতে কাজ করে শাড়ি বানানো শিখেছে। তাই আমরা আরও কিছু জায়গা নিয়ে তাঁত বসাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যে তাঁতিরা প্লট বেঁচে দিচ্ছে তা বাইরের লোকজন অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনছে। আমাদের পক্ষে অত টাকা দিয়ে নতুন প্লট কেনা সম্ভব নয়। ধারণা পাওয়া গেছে, এসব কারণে অনেকে চাইলেও বাড়াতে পারছেন না জামদানি পল্লীর কলেবর। জামদানি পল্লীতে থাকেন মুদি দোকান ব্যবসায়ী নাছিম মিয়া। অন্য ব্যবসায়ে থেকে কীভাবে প্লট পেলেন— জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার শ্বশুর ছিলেন তাঁতি। তিনিই প্লটটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। পরে দেনার দায়ে বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে আমি কিনে নিয়েছি। আর এখানে মুদি দোকান ভালোই চলে দেখে ব্যবসা করে খাই। শুধু নাছিম মিয়াই নয়, তাঁতি পল্লীর এলাকা জুড়ে এরকম বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তৈরি করছেন দালান-কোঠা। এখানকার অনেকে আত্মীয়ের মাধ্যমে আবার অনেকে টাকার জোরে তাঁতিদের কাছ থেকে কিনেছেন প্লট। এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ শিল্পনগরী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, অনেক তাঁতিই বিসিককে না জানিয়ে অন্য পেশাজীবীদের কাছে প্লট বিক্রি করেছেন। এ জন্য আমরা বেশকিছু প্লট বাতিলও করেছি। আমরা প্রতি তিন মাস পর পর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেই এবং কেউ বিধিবহির্ভূত কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।

 

সর্বশেষ খবর