সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পালাচ্ছে ট্যানারি মালিকরা আন্দোলনমুখী শ্রমিকরা

৩০ কোটি টাকা জরিমানা মওকুফ ট্যানারির বর্জ্যে মাছ মুরগির খাবার নয় —— আপিল বিভাগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্ধের অজুহাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা। ফলে বেতন-ভাতা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তায় আন্দোলনে যাচ্ছেন সদ্য বন্ধ হওয়া প্রায় দুই শতাধিক কারখানার ৪০ হাজার শ্রমিক। শনিবার ইউটিলিটি সার্ভিস কেটে দেওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে ট্যানারিগুলোতে। পাওয়া যাচ্ছে না মালিকপক্ষের কাউকে। ফলে শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। আর এ নিয়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা না থাকায় অনিশ্চয়তায় পড়া শ্রমিকরা ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানারি শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে আজ সকাল ১০টায় হাজারীবাগ ট্যানারি মোড়ে শ্রমিক সমাবেশের আহ্বান করা হয়েছে। তারা সমাবেশ থেকে বকেয়া বেতনসহ সাত দফা দাবি পেশ করবেন। গতকাল দেখা গেছে, প্রায় অর্ধশত কারখানার মেশিনারিজ সরিয়ে নিতে পারেনি মালিকপক্ষ। সেখানে পড়ে আছে সব মেশিন। পানির লাইন কাটা। বিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন। বন্ধ সব ধরনের কাজকর্ম। কারখানার ভিতরে ঢুকলেই মনে হবে ভুতুড়ে বাড়ি। চারদিকে শুধু অন্ধকার। মার্চ মাসের বেতনের জন্য সারা দিনই আসছেন শ্রমিকরা। কিন্তু মালিকপক্ষের কেউ নেই। হাজারীবাগের বন্ধ সব কারখানার চিত্র একই রকমের। শ্রমিকরা বলছেন, গেল মার্চ মাস কাজ করেছি। চলতি মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত দিনেও ১২ ঘণ্টা করে কাজ করছি। কিন্তু মালিক কোনো বেতন না দিয়ে উধাও। কবে বেতন পাব, সেটা জানাতে পারেননি ম্যানেজার। ঘরভাড়া নিয়ে অনেকের চিন্তার শেষ নেই। বাড়িওয়ালাকে কী জবাব দেব। এসব কথা বলছিলেন হামিদ ট্যানারির শ্রমিক উম্মে কুলসুম। বাংলাদেশ ট্যানারির অপারেটর আলম মিয়া বলেন, কারখানায় তো এক মাস পুরো কাজ চলেছে। সব শিপমেন্ট হইছে। মালিকরা পেমেন্টও পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের মার্চ মাসের বেতন মালিকরা দিচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, কারখানা বন্ধ এমন অজুহাতে মালিকপক্ষের কেউ কারখানায়ই আসেননি। মিল্লাত ট্যানারির শ্রমিকরা বলছেন, সরকার নাকি আমাদের ঘর বানানোর জন্য সাভারে মালিকগো জায়গা দিয়েছে। কিন্তু সাভারে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা সে বিষয়েও মালিকরা আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করছেন না। আমরা এখন যাব কোথায়? আমরা তো না খেয়ে মারা যাব। পরে কী করব তা তো অনেক পরের কথা। চলতি মাসে চলব ক্যামনে-এমন আক্ষেপের কথা জানান প্রগতি ট্যানারির শ্রমিকরা। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বন্ধ করে সেখানকার গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পরিবেশ অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। ৮ এপ্রিল হাজারীবাগের প্রায় সব কারখানার বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু মালিকপক্ষ লাপাত্তা হওয়ায় হাজারীবাগের ২০০ কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক বেতন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

ট্যানারির ৩০ কোটি টাকা জরিমানা মওকুফ : রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানায় গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর পরিবেশের ক্ষতিপূরণ বাবদ দৈনিক ১০ হাজার টাকা করে এবং বকেয়া ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানার অর্থ মওকুফ করা হয়েছে। আদালতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেয়। তবে প্রত্যেক ট্যানারিকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা করে ১৫ দিনের মধ্যে শ্রম সচিবের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সাভারে স্থানান্তরিত শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম সচিব এই অর্থ ব্যয় করবেন। আদালতে ট্যানারি মালিকদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এর আগে ৩০ মার্চ আদালত হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানাগুলো ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের পর ট্যানারি কারখানাগুলোর জরিমানার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলেও ওইদিন জানায় আদালত। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গতকাল গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হয়। ২ মার্চ হাজারীবাগের ১৫৪টি ট্যানারি কারাখানাকে পরিবেশের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বকেয়া ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে দুই সপ্তাহ সময় দেয় হাই কোর্ট। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের এক সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন হাই কোর্ট এই আদেশ দেয়। আদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন আপিল বিভাগে আবেদন করে। ১৯ মার্চ চেম্বার আদালত আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে হাজারীবাগে ট্যানারি চালু রাখায় গত বছর ১৫৪ প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা নির্ধারণ করে আপিল বিভাগ। পরে ট্যানারি মালিকরা এ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন।

ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মাছ ও মুরগির খাবার নয়—আপিল বিভাগ : মুরগি ও মাছের খাবার তৈরিতে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার বন্ধে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে করা আবেদন খারিজ করে গতকাল প্রধান বিচারপতি ?সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল  মোরসেদ। মাছ ও মুরগির খাদ্যে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্তি করে হাই কোর্টে রিট করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশ। আবেদনে বলা হয়, ট্যানারি বর্জ্য ব্যবহার করে  তৈরি করা খাদ্য মুরগি ও মাছ উভয়ের জন্যই অস্বাস্থ্যকর। এসব অস্বাস্থ্যকর খাদ্য দিয়ে চাষ করা মুরগি ও মাছ খেলে মানুষের জন্যও মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। রিটের পরে ২০১০ সালের ২৬ জুলাই ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে মাছ ও পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ কেন  দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করে। ২০১১ সালের ২১ জুলাই হাই কোর্ট এক মাসের মধ্যে বর্জ্য দিয়ে মাছ-মুরগির খাবার তৈরির কারখানা বন্ধের নির্দেশ  দেয়। হাই কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফিশ মিট ও অ্যানিমেল গ্লু প্রস্তুতকারক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার লিভ টু আপিল করেন। গত ৭ ডিসেম্বর সেই লিভ টু আপিল খারিজ হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল ফর রেস্টোরেশন (পুনর্বহালের আবেদন) করেন গোলাম সরোয়ার।

সর্বশেষ খবর