মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারি জমি দখল করে কোটি টাকার মালিক

উচ্ছেদ অভিযানে বাধা হয়ে দাঁড়ান সংরক্ষিত আসনের এমপি

মাহবুব মমতাজী

সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা দখল করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর এই অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু লোকজন। এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরাই বাধা দেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনিভাবে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন খালও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বাড়ি যার যার, খালের জায়গাও তার তার নীতি অনুসরণ করা হয়।

জানা গেছে, পূর্ব ধোলাইপাড়ে কদমতলী যাওয়ার পথে খালটি সারিবদ্ধভাবে প্রায় অর্ধেক অংশ দখল করে রাখা হয়েছে টং দোকান দিয়ে। প্রায় এক কিলোমিটারের দীর্ঘ খালটি যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইপাড় এলাকাকে পৃথক করেছে। এখানকার দোকান থেকে প্রতি মাসে চাঁদা তোলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। সেখানে অন্তত পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। যেখান থেকে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া তোলা হয়।

এলাকার মুসা নামের এক বাড়িওয়ালা বলেন, বেশির ভাগ দোকান থেকে টাকা তুলে খায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও মাতব্বর। যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের লোকই এই খাল নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে।

ওই এলাকার স্থানীয় এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাছিম মিয়া জানান, সেখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবু। হাবু, রোকন ও ডালিমসহ আরও কয়েকজন এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।  

জানা গেছে, গত ১ বছরের সেপ্টেম্বর সায়েদাবাদ টার্মিনালে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে দখলে থাকা ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে যায় সিটি করপোরেশন। এ সময় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অভিযান শুরুর জন্য বুলডোজার, পুলিশের এপিসি নিয়ে উচ্ছেদের প্রস্তুতি নিলে কাজী হাবিবুর রহমান হাবুর নেতৃত্বে তাতে বাধা দেয় সেখানকার শ্রমিকরা। এ ঘটনায় পরবর্তীতে অভিযুক্ত হাবুকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাবিবুর রহমান হাবুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনের কিছু দূর থেকে শুরু করে জুরাইন রেলগেট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রেল লাইনের দুই ধার ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে মুদি বাজার। এই বাজার সম্পর্কে শফিক নামের সেখানকার এক দোকানদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, এই বাজারটি রেলের জায়গার ওপর অনেক আগ থেকেই আছে। আর এখান থেকে কোনো ধরনের কর বা ভাড়া রেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয় না। এই বাজারের সঙ্গে সিটি করপোরেশনেরও কোনো সম্পর্ক নেই। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এই বাজারটি আগে নিয়ন্ত্রণ করতেন জুরাইন বাজার বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি হাজী আবদুর রহিম। তিনিই আয়তন অনুসারে প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ৪০-১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করতেন। মাসে ওই বাজার থেকে প্রায় কোটি টাকার চাঁদা লেনদেন হয়। যেটি এখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এ নিয়ে অন্তত তিনবার উচ্ছেদ অভিযানে গেলেও তা সম্পন্ন করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গত ২৯ নভেম্বর জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন জুরাইন বাজার উচ্ছেদ অভিযানে যায় রেলওয়ের ডিভিশনাল স্টেট অফিসার রেজাউল করিমের নেতৃত্বাধীন একটি দল। বুলডোজার দিয়ে কিছু দোকান ভাঙার পর তা মেরামত করে পুনরায় সেখানে ব্যবসা শুরু করেছেন দোকানদাররা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ইশারায় তা করা হয়েছে। তবে উচ্ছেদ অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী ও জুরাইন বিক্রমপুর মার্কেটের ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির জানান, রেলওয়ের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ‘টিপটপ’ হোটেল ভাঙতে গেলে হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সংরক্ষিত আসনের এমপি সানজিদা খানম। তিনি হোটেলের মালিক-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে বুলডোজারের সামনে বসে পড়েন। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যসহ রেলওয়ের স্টেট অফিসার তাকে সরে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। উল্টো তিনি বলেন, আমি বলছি, আপনারা পুলিশ নিয়ে চলে যান। আমি বেঁচে থাকতে এখানে কোনো স্থাপনা ভাঙতে পারবেন না।  এ বিষয়ে স্থানীয় এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংরক্ষিত আসনের একজন এমপি সেখানে বাধা দিয়েছেন তা সবাই দেখেছে। সানজিদা খানমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি উচ্ছেদ করতে হয়, তাহলে গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশন থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত উচ্ছেদ করতে হবে। সেটি করা হলে আমি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সব ধরনের সহযোগিতা করব। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গায় উচ্ছেদ করা যাবে না। জানা গেছে, গেণ্ডারিয়া থানা এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ডিআইটি ও নামাপাড় নামে দুটি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬/৩৫ ডিআইটি প্লট (নতুন বাজার) রাস্তার সংলগ্ন চারপাশ দখলদারের নানা ধরনের সাইনবোর্ডে ছোট হয়ে আসছে ডিআইটি পুকুরটি। আর এসব দখলে রেখেছে কিছু হোটেল, দোকান, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, কার-মাইক্রো ও ট্রাক শ্রমিক এবং জলসা ঘর নামে বিভিন্ন সংগঠন। তারা পুকুরের পাড় ভরাট করে নিজেদের কার্যালয় গড়ে তুলেছে। আর এসব ঘটনার পেছনে বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ বলেন, আমরা রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত উচ্ছেদ করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উচ্ছেদের পর তা ধরে রাখা যায় না। কারণ এটি ধরে রাখার দায়িত্ব পুলিশের, উল্টো পুলিশই সেসব জায়গায় গিয়ে চাঁদাবাজি করে।

সর্বশেষ খবর