বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে দুই নেতা মুখোমুখি

মহিউদ্দিনের অভিযোগের তীর নাছির ও তিন এমপির বিরুদ্ধে, নাছির বললেন ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনি

রিয়াজ হায়দার, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে দুই নেতা মুখোমুখি

আবার মুখোমুখি দুই নেতা। একজন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অন্যজন একই মহানগরের দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তাদের তিন দশকের পুরনো বিরোধ আবার প্রকাশ্যে আসায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ এখন প্রশ্নের মুখে।

একজন অভিযোগ তুলেছেন। অন্যজন আত্মপক্ষ সমর্থন করে পাল্টা জবাব দিলেন। দুয়ে মিলে টালমাটাল দশা। দুজনের অম্ল-মধুর সম্পর্ক নিকট অতীতে নানাভাবে প্রকাশ্য হলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার দিনেই চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে ঘটল তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের চূড়ান্ত প্রকাশ।

কেবল মেয়র নাছিরের বিরুদ্ধে নয়, ক্ষমতাসীন দলের তিন এমপি, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ও বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগের আঙ্গুল তুললেন চট্টগ্রামের তিনবারের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী।

দলীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম যখন দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাপ্তি নিয়ে আনন্দ মিছিল করছিলেন, ঠিক তখনই অদূরে লালদীঘি মাঠে দলীয় প্রধানকে অভিনন্দন জানাতে নয়, অভিযোগ জানাতেই যেন বক্তব্যের খই ফোটালেন সত্তরোর্ধ্ব মহিউদ্দিন চৌধুরী। আর এ নিয়ে চলছে এখন চট্টগ্রামজুড়েই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, খোদ দলের সভাপতি হয়ে সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুললেন কেন তিনি? তবে কি তিন দশকের পুরনো বিরোধ মিইয়ে এসে নিকট অতীতে ঐক্যের যে ভিত দৃশ্যমান হয়েছিল, তা উবে যাবে? তবে কি বিরোধ স্থায়ী হবে? আবার কি তবে লালদীঘি মাঠে পুরনো দিনের সেই দুই পক্ষের প্রকাশ্য গোলাগুলির মতো অঘটন দরজায় কড়া নাড়ছে? এমন সব প্রশ্ন এখন দলের সাধারণ কর্মী-শুভার্থীর মধ্যে।

বিরোধের সূত্রপাত : সেই তিন দশক আগের কথা।  ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা বখতেয়ার খানকে নিয়েই চট্টলার আওয়ামী লীগের বর্তমান এই দুই শীর্ষ নেতার বিরোধের সূত্রপাত। মহিউদ্দিন চৌধুরী তখন মহানগর আওযামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। আর আ জ ম নাছির উদ্দিন ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তুচ্ছ কারণে বখতেয়ার খানকে নগরের রাইফেল ক্লাবের কাছে গ্র্যান্ড হোটেলে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন মহানগর আওযামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম কাজী ইনামুল হক দানু। তারা সবাই ছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এম এ মান্নান ও যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। কিন্তু ছাত্রনেতা বখতেয়ার খানকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে বিচার চেয়েও না পাওয়ায় উত্তর-দক্ষিণ মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক বিশাল অংশ তৎকালীন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর শরণাপন্ন হয়। তখন থেকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরোধী ধারায় সক্রিয় হন আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ অন্যরা। দলীয় নির্ভরযোগ্য কয়েকজন নেতার কাছে এসব পুরনো তথ্য পাওয়া যায়।

তিন দশকের বিভক্তির জেরে মহিউদ্দিন চৌধুরী দুবার দল থেকে আ জ ম নাছির উদ্দিনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে পাঠান। কিন্তু কেন্দ্র তা অনুমোদন না করলেও অন্তত ২০ বছর দলীয় কোনো পদ-পদবি জোটেনি নাছিরের। তবে নানা প্রলোভনেও দল ছেড়ে যাননি তিনি। অন্যদিকে ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ক্রমে ‘গণমুখী’ নেতা হয়ে ওঠেন। একাধিকবার মহানগরের সভাপতি হন তিনি। তিনবার মেয়র হন। নানা ইস্যুতে মাঠে সক্রিয় থাকা নেতার নাম মহিউদ্দিন। অন্যদিকে দীর্ঘ ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ নাছির হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গেল নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী মহিউদ্দিন চৌধুরীর বদলে মেয়র পদে মনোনয়ন পান আ জ ম নাছির। নির্বাচনে তার বিজয়ের পর থেকেই নানা সময় বিভক্তি প্রকাশ্য হয়ে ওঠে এ দুই নেতার; যার সর্বশেষ প্রকাশ সোমবারের লালদীঘি মাঠে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমাবেশ থেকে।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর যত অভিযোগ : লালদীঘি মাঠের সমাবেশে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, নাছির সাহেব সিটি করপোরেশনের দরজায় তালা মেরে সারাক্ষণ বন্দর চেয়ারম্যানের রুমে বসে থাকেন। তিন সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, শামসুল হক চৌধুরী ও দিদারুল আলম সংসদে কথা না বলে বন্দর চেয়ারম্যানের অফিসেই কথা বলেন বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি। মেয়রকে অপসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন বলে জানান মহিউদ্দিন। এ ছাড়া তিনি অভিযোগ তোলেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা সৈয়দ ছগীর, ফিশারিঘাটের বাবুল সরকার, মোহাম্মদ আলী ও মাসুদ নিজামের বিরুদ্ধেও।

অভিযোগ সম্পর্কে মেয়র নাছির যা বললেন : এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, হয় তিনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বলেছেন অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলেছেন। তিনি ১৭ বছর মেয়র থাকাকালে মাস্টারপ্ল্যান না মেনে যত্রতত্র মার্কেট নির্মাণ করে অপরিকল্পিত কাজের মাধ্যমে নগরের জলাবদ্ধতার কারণ তৈরি করেছেন। আর তা মোকাবিলা করে নতুন মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগী হওয়ায় উন্নয়ন ও সেবা বাধাগ্রস্ত করতেই তিনি (মহিউদ্দিন) ষড়যন্ত্রে মেতেছেন।

বন্দর চেয়ারম্যানের দফতরে বসা প্রসঙ্গে নাছির বলেন, কাল্পনিক অভিযোগ না করে বন্দর চেয়ারম্যানের দফতরের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হোক। নাছির আরও বলেন, ‘চসিক কখনই তালাবদ্ধ ছিল না। ঈদ-কোরবানি, পূজা-পার্বণ এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও আমি চসিকে সক্রিয় আছি।’ নিজ সংগঠনের সভাপতির এমন সব অভিযোগের ব্যাপারে সাংগঠনিক করণীয় প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ মেয়র নাছির বলেন, ‘লালদীঘি মাঠে সরকারবিরোধী নাশকতার মামলার আসামি মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হেলাল উদ্দিন বাবরকে নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী সমাবেশ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘বিলবোর্ড অপসারণে সফলতা, আলোকায়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়েই মহিউদ্দন চৌধুরী উন্নয়ন ও সেবা বাধাগ্রস্ত করতে মাঠে নেমেছেন।’

পাল্টা বক্তব্যে মহিউদ্দিন : মেয়র নাছিরের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মহিউদ্দিন চৌধুরী জানান, ১৭ বছর মেয়র থাকাকালে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নয়, মেয়র নাছিরের ভুল শোধরানোর জন্য তিনি জনগণের দাবি তুলে ধরেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘জনগণের জন্য রাজনীতি করি। কেউ না বললেও জনগণের কথা আমি বলে যাব।’ তিনি বলেন, ‘আমার মধ্যে অন্তর্জ্বালা থাকলে মেয়র নির্বাচনে নাছিরকে সমর্থন করতাম না। তিনি সংশোধন হয়ে এলে আবারও তার পাশে থাকব।’

 

সর্বশেষ খবর