বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব

জিন্নাতুন নূর

দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব

ঘরে ঘরে এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ তথা ১৪২৪ বঙ্গাব্দ উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ এই দিনটি ঘিরে এখন দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছে সর্বস্তরের মানুষ। একদিকে গৃহিণীরা ঘরের সাজসজ্জা ও মজাদার খাবারের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত, অন্যদিকে শপিং মলগুলোয় ব্যবসায়ীরা বৈশাখের পোশাক বেচাকেনায় দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বৈশাখী শোভাযাত্রার শেষ মুহূর্তের আয়োজন নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় উৎসবের (ঈদ ও দুর্গাপূজা) তুলনায় আয়োজনের ব্যাপ্তি ও পণ্যের বেচাকেনার দিক দিয়ে এ দেশের সর্ববৃহৎ উৎসব হয়ে উঠছে পয়লা বৈশাখ। গত এক যুগের বেশি সময় বাংলা নববর্ষ পালনের ধরন বিশ্লেষণ করে লক্ষ্য করা যায়, এখন আর গ্রামকেন্দ্রিক মেলা আয়োজনের মধ্যে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন সীমাবদ্ধ নেই। শহরেও এ উপলক্ষে এখন মেলা আয়োজন, পোশাকসহ হরেক রকম পণ্য কেনাবেচা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, হরেক রকমের খাওয়া-দাওয়া ও অতিথি আপ্যায়নের তোড়জোড় চলে। এমনকি গত মার্চের বেতনের সঙ্গে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উৎসব ভাতা পেয়েছেন দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা। বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ। মুসলমান, হিন্দুসহ অন্যসব ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর আলাদা ধর্মীয় উৎসব থাকলেও জাতিধর্মনির্বিশেষে নববর্ষ সবার উৎসব। অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে সবাই এই উৎসবে অংশ নেন। এমনকি আদিবাসীরাও পয়লা বৈশাখে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। সেই অর্থে পয়লা বৈশাখ আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব হওয়ায় আমি আনন্দিত।’ দেশজুড়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার পরও বৈশাখের আয়োজনে কোনো কমতি নেই। এ থেকেই স্পষ্ট হয় দিনে দিনে এটি বাঙালির কতটা প্রাণের উৎসব হয়ে উঠেছে। আর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাপ্তিও হবে বিশাল। কারণ এ শোভাযাত্রা গত নভেম্বরে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’। আর শোভাযাত্রায় থাকছে হাতে তৈরি ঘোড়া, বিশাল বাঘের মুখ, হাতি ইত্যাদি অবয়ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া শিশু, যুবক-যু্বতী এবং সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। মাসব্যাপী চলে এর প্রস্তুতিপর্ব। রাজধানীতে বাংলা নববর্ষের মূল আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার রমনা পার্কের বটমূলে। এখানে প্রভাতি সংগীত আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা। অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবে অনেক আগে থেকেই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মহড়ায় অংশ নেন। তাদের সঙ্গে নববর্ষের সকালে রাজধানীবাসীও ‘এসে হে বৈশাখ, এসো এসো...’ গানটিতে গলা মিলিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবেন। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সন্জীদা খাতুন জানান, ১৯৬৩ সালে ছায়ানটের যাত্রা হয়। এরপর রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, শুদ্ধ সংগীত, পল্লীগীতিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সন্জীদা খাতুনসহ সমকালীন অন্যরা তখন মানুষের ঐতিহ্যপ্রীতি বাড়াতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের রীতি শুরু করেন। ঢাকার রমনা উদ্যানে অশথ গাছের নিচে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাত তথা ইংরেজি ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান। এরপর অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় ‘বটমূল’। এবার ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজনের ৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে গোটা রমনা বটমূলসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নববর্ষ উপলক্ষে বসে লোকজ মেলা। বিভিন্ন সংগঠন কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। নববর্ষে দেশের সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের বাংলা খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। এদিন দেশের সব জাদুঘর ও প্রত্নস্থান সাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও প্রবাসী বাঙালিরা এখন বেশ ঘটা করে এই উৎসব পালন করছে। তা ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ মিশনগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। সব মিলিয়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মধ্যে এখন এক ধরনের উৎসব-পূর্ববর্তী আমেজ কাজ করছে। সর্বজনীন এই উৎসবে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে মুসলমান এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা প্রাণে প্রাণ মেলাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির ওপর এখন অনেক কিছু বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এমন সংস্কৃতির প্রয়োজন নেই, যা সংঘাত সৃষ্টি করে। পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে সরকার বোনাস দিচ্ছে। কিন্তু সমাজের সবাই বিষয়টিকে একভাবে দেখছেন না। বিশেষ করে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে তারা একে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।’ বৈশাখের প্রথম দিনে রঙিন শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে সেজে পথে নামে রাজধানীবাসী। এই সাজে সেদিন বেশকিছু বিদেশি নাগরিককেও ঢাকার পথে পাওয়া যায়। এই দিনে কাচের চুড়ি, আলতা, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন উপাদান বাঙালি নর-নারীর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করে।

পোশাক ব্যবসায়ীরা জানান, বছরজুড়ে তাদের যে বিক্রি হয় তার ১৫ শতাংশই হয় বৈশাখকেন্দ্রিক। এমনকি এ সময় হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতেও ব্যবসা জমে ওঠে। কারণ, সারা দিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ক্লান্ত নগরবাসীর অনেকেই ঘরের বাইরে খাবার গ্রহণ করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসাও তুঙ্গে ওঠে। আর উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠিত কনসার্টে নামে তারুণ্যের ঢল।

সর্বশেষ খবর