শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চা বাগানে শিক্ষার আলো

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

চা বাগানে শিক্ষার আলো

একসময় চা-বাগানে শিক্ষার সুযোগ না থাকায় যে শ্রমিকরা লেখাপড়া করতে পারেনি, আজ তাদেরই শিশু সন্তানরা লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাদের কেউ এখন বাগানের ফ্যাক্টরি বাবু, কেউ সরকারি চাকরিজীবী, কেউবা পুলিশ হতে চায়। এমনই স্বপ্নের কথা জানাল শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা-বাগানের রাজঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শুভাং তাঁতি, সাকিল ভূমিজ, অধীর শুক্ল বৈদ্য, উপন তাঁতি ও অংশু তাঁতি। আজ আর শুধুু রাজঘাট চা-বাগান নয়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রতিটি চা-বাগানের শ্রমিক-সন্তানের চোখেই লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন। বাগানের শিশুরা এখন সকাল হলেই বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার ছুটির পর পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ঘরে ফিরছে। সরেজমিন দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে চা-বাগানে স্থাপিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শ্রমিক-সন্তানদের আলোকিত জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষার আলো। এ নিয়ে কথা হয় জাগছড়া চা-বাগানের শ্রমিক গণেশ গোয়ালার সঙ্গে। তিনি জানান, নিজে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি, কিন্তু এখন তিন সন্তানকেই লেখাপড়া করাতে পারছেন। তার প্রথম মেয়ে ঊর্মি বিএ পড়ছে, দ্বিতীয় ছেলে রাজেশ এইচএসসি ও তৃতীয় মেয়ে শিপা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার বিদ্যালয়বিহীন চা-বাগানে ২০১০-১১ ও ২০১২ সালে ৩৪টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে তিন ধাপে এই ৩৪টি বিদ্যালয় সরকারিকরণ করা হয়। চা শ্রমিক-সন্তানদের বিদ্যালয়মুখী করতে শতভাগ ছাত্র-ছাত্রীকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোকে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততায় আরও কাজে লাগাতে সরকারিভাবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার টাকার স্লিপ অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সাতগাঁও, কালীঘাট ও রাজঘাট ইউনিয়নের চা-বাগানে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঝরে পড়া রোধে শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ অবারিত করতে রস্ক প্রকল্পের আওতায় চা-বাগানগুলোয় ৮৭টি আনন্দ স্কুল চালু করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে ৮ হাজার ২৬ জন চা শ্রমিক-সন্তান ভর্তি রয়েছে। তা ছাড়া সারা দেশে বিদ্যালয়বিহীন গ্রামের ১ হাজার ৫০০টি বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় এ উপজেলার

পাহাড়ি এলাকা নিরালাপুঞ্জি, মাইজদিহি পাহাড় ও মাধবপাশা গ্রামে ৩টি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করে নতুন ভবন নির্মাণসহ সরকারিকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া চা শ্রমিক-সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এলাকায় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ মো. আবদুস শহীদ নিজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই কলেজের অধ্যক্ষ পিয়ালী ভৌমিক বলেন, এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে এলাকার চা শ্রমিক-সন্তানদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। কলেজের ৮০ শতাংশ ছেলে-মেয়েই সুবিধাবঞ্চিত। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীই চা শ্রমিক-সন্তান।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা-বাগানগুলোয় শ্রমিক-সন্তানরা এখন মানসম্মত লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শুধু এই এলাকার সংসদ সদস্য সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায়। এ উপজেলার মতো অন্য উপজেলার চা-বাগানগুলোতেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শ্রমিক-সন্তানদের মানসম্মত লেখাপড়া করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। খেজুরীছড়া চা-বাগানের র‌্যানার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক নুরুল হক বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে চা-চাগানে শিক্ষার বিপ্লব ঘটেছে। এই স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২ হাজার ৪৫৪ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর ৯৫ শতাংশই চা শ্রমিক-সন্তান। এ ছাড়া ২০১৫ সালে স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই কলেজে এখন ৬৬ জন চা শ্রমিক-সন্তান লেখাপড়া করছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘চা-বাগান এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিটি শিশুকে আমরা বিদ্যালয়ে আনতে পেরেছি। শিশুসহ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ শিশুকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়েছে। চা-বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মিডডে মিল চালুরও চেষ্টা করা হচ্ছে।’ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ এমপি বলেন, ‘চা-বাগানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু বিসিএস, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় শিক্ষক নেতা ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় মাত্র ছয় মাসে এই কঠিন কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আর শিক্ষক নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে চা জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত সন্তানদের। প্রতিটি চা-বাগানের ম্যানেজারকে সভাপতি করে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর