শিরোনাম
সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি

সনদের কমিটি নিয়ে বিরোধ ফের তুঙ্গে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

সনদের কমিটি নিয়ে বিরোধ ফের তুঙ্গে

‘রাবেতাতিল জামেআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি কওমি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ‘ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্স’ ডিগ্রি স্বীকৃতি নিচ্ছেন কওমিরা। এ স্বীকৃতি নিয়ে সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে ৩২ সদস্যের একটি ‘কওমি মাদ্রাসা সনদ বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির ২২ জনই কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সদস্য হওয়ায় চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে অন্যান্য শিক্ষা   বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এ নিয়ে কওমিদের পুরনো বিরোধ আবার চাঙা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন ঘোষণার আগেই কমিটি গঠন করায় অসন্তুষ্ট উত্তরবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সভাপতি এবং জামেয়া ইসলামিয়া গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘কেউ চাইলেও কমিটি গঠন করতে পারবে না। সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির পরই কমিটি গঠনের বিষয়ে দেশের শীর্ষ আলেমরা বৈঠকে বসবেন। ওই বৈঠকে সবার পরামর্শে কমিটি গঠন করা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এককভাবে কোনো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বাধিক সদস্য রাখতে পারবে না। তবে বেফাক বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চেয়ারম্যান পদটি তারা পেতে পারে। বাকি সব পদ সবার মধ্যে আনুপাতিক হারে দিতে হবে।’ সনদ বাস্তবায়ন কমিটিতে নিজেদের একক আধিপত্যের কথা স্বীকার করেছেন বেফাক মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। সদস্যসংখ্যা বেশি রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বেফাক ছাড়া দেশের অন্য যেসব শিক্ষা বোর্ড রয়েছে, তাদের কারোরই মাদ্রাসা সংখ্যা বিশের অধিক নয়। কিন্তু বেফাকের সদস্য ৬৭৮টি। তাই বেফাক থেকে সনদ বাস্তবায়ন কমিটিতে সদস্য বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।’ জানা যায়, মঙ্গলবার রাতে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পরদিন বুধবার ঢাকার খিলগাঁওয়ের মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় বৈঠকে বসে কওমি আলেমদের একটি অংশ। ওই বৈঠকে ‘রাবেতাতিল জামেআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে একটি কওমি শিক্ষা বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে ‘কওমি মাদ্রাসা সনদ বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় বেফাক সভাপতি ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীকে। কো-চেয়ারম্যান হন আল্লামা আশরাফ আলী। ওই কমিটিতে বেফাক থেকে পাঁচজন এবং আল্লামা আহমদ শফীর পক্ষ থেকে ১৫ জনসহ বেফাকের ২২ জনকে স্থান দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাকি পাঁচ কওমি শিক্ষা বোর্ড থেকে দুজন করে প্রতিনিধি রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ পাঁচ কওমি মাদ্রাসা হলো ইত্তিহাদিল মাদারিস কওমিয়া চট্টগ্রাম, আজাদ দীনি এদারায়ে তালিম সিলেট, উত্তরবঙ্গ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক, জাতীয় কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ এবং এদারায়ে তালিমিয়া দীনি বোর্ড। আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আল্লামা আশরাফ আলী, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা আবদুল হামিদ, মুফতি ফয়জুল্লাহ প্রমুখ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা বলেন, “দেশের শীর্ষ আলেমদের ছাড়াই ‘কওমি মাদ্রাসা সনদ বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। একে ‘কওমি মাদ্রাসা সনদ বাস্তবায়ন কমিটি’ না বলে বেফাক কমিটি বলাই শ্রেয়। চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানসহ ২২ পদই বেফাকের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। সদস্যসচিব পদ রাখার কথা থাকলেও সেই পদটি রাখা হয়নি। অন্যান্য বোর্ডের কেউ চাইলেও চেয়ারম্যান কিংবা কো-চেয়ারম্যান হতে পারবে না। এ দুটি পদ আজীবনই বেফাক রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ধরনের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করব।”

জানা যায়, দেশে ১৪ হাজারের মতো কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১২ হাজার পুরুষ ও দেড় হাজার মহিলা মাদ্রাসা। শিক্ষার্থী প্রায় ১৪ লাখ। এসব কওমি মাদ্রাসা পরিচালিত হয় ছোট-বড় কমপক্ষে ২৫টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এসব কওমি শিক্ষা বোর্ডের অন্যতম হলো বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক), আঞ্জুমানে ইত্তিহাদিল মাদারিস, জাতীয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ, তানজিমুল মাদারিস, এদারায়ে তালিমিয়া দীনি বোর্ড, আজাদ দীনী এদারায়ে তালিম সিলেট, মাদারিসিল কওমিয়া বাংলাদেশ, কুমিল্লা তানযিমুল মাদারিস, দক্ষিণ ঢাকা এদারা, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা পরিষদ, কওমি মাদ্রাসা ঐক্য পরিষদ, দীনি শিক্ষা বোর্ড, বেফাকুল মাদারিস কওমিয়া, ইলহাকুল মাদারিস অন্যতম।

অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দাওরায়ে  হাদিসের পরীক্ষা : ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হবে দেশের সব কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম। এ বোর্ডের অধীনেই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে নেওয়া হবে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা। গতকাল হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় কওমি মাদ্রাসার সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা আহমদ শফী সভায় সভাপতিত্ব করেন। কওমি মাদ্রাসাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আল্লামা আহমদ শফী। তিনি বলেন, কওমি স্বকীয়তা শতভাগ অক্ষুণ্ন রেখে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান দিয়েছে সরকার। এ স্বীকৃতিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বেফাক আমিরের প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমেদ বলেন, সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামী ১৫ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত দেশের সব কওমি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। গতকাল হাটহাজারী মাদ্রাসায় বৈঠকে বসেন কওমির শীর্ষ আলেমরা। ওই বৈঠকে পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে- ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে সর্বোচ্চ সংস্থার আওতায় দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদবিষয়ক কার্যক্রম। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একসঙ্গে সব বোর্ডের আওতাধীন মাদ্রাসাসমূহে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা গ্রহণ। চলতি শিক্ষাবর্ষের দাওরায়ে হাদিসের চূড়ান্ত পরীক্ষা ১৫ মে থেকে ২৫ মের মধ্যে গ্রহণ। বেফাক থেকে ৬ জন এবং অন্য ৫ বোর্ড থেকে ১ জন হারে মোট ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক উপকমিটি গঠন করা হয়। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মাওলানা শামসুল হককে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনোনীত করা হয়। ৬ বোর্ডে নিবন্ধিত দাওরায়ে হাদিসের মাদ্রাসাসমূহ ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ সংস্থায় নিবন্ধিত মাদ্রাসা বলে গণ্য করা। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মুফতি রূহুল আমীন, মুফতি আরশাদ রাহমানী, মাওলানা আবদুল হামিদ পীরসাহেব মধুপুর প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর