ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর বৈশাখ আসে। সবাই আনন্দ উৎসব করে। আমি দিন-রাত কেঁদে কাটাই। এ মাস আমার জন্য সর্বনাশের মাস। এ মাসেই নিখোঁজ হয় আমার কলিজার টুকরা। পাঁচ বছর সবাই মিথ্যে আশার বাণী শুনিয়েছে। একে একে পাঁচটি বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি। আজও জানি না কেমন আছে, কোথায় আছে আমার ছেলে? কথাগুলো বলছিলেন বিএনপির নিখোঁজ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা সভাপতি এম ইলিয়াস আলীর মা সূর্যবান বিবি (৭৫)। ইলিয়াসের রামধানার গ্রামের বাড়িতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন তিনি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাফেরা করছেন তিনি। ভরসাহারা দৃষ্টিতে দেখছেন এদিক-ওদিক। ছেলের চিন্তায় ভেঙে গেছে শরীর, মন। চোখের নিচে কালি। গণমাধ্যমে প্রথমে কথা বলতে চাননি। পরে দীর্ঘ সময় মনের কষ্ট, দুর্বিষহ যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, কথা বলে কী আর হবে। অনেক তো বলেছি, ছেলের সন্ধান দিতে পেরেছে কেউ? হতাশার কষ্টে হারাতে বসেছি স্মৃতি শক্তি। পাগল আর আমার এখন কোনো তফাত নেই। অনেক আহাজারি, কাকুতি-মিনতি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সবার কাছে ছেলের সন্ধানে ভিক্ষা চেয়েছি। মিথ্যা আশা পেয়েছি, ছেলের সন্ধান পাইনি। ছেলের জন্যে বৃহস্পতিবার চারটি গরু জবাই করে গ্রামে বিলিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ ছাড়া এখন আর কাউকে কিছু বলি না। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে গাড়িচালক আনসারসহ নিখোঁজ হন এম ইলিয়াস আলী। পরদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় তার প্রাইভেটকার উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত নিখোঁজই রয়ে গেছেন তিনি। কেউ দিতে পারেনি এ নিখোঁজ রহস্যের সমাধান।
মৃত্যুর আগে ছেলের সন্ধান চান আনসারের মা : এদিকে তিন বছরের চাঁদনী যখন বাবা ডাকতে শিখল, তখনই ‘নিখোঁজ’ হন তার পিতা আনসার আলী। তিনি এম ইলিয়াস আলীর ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছিলেন। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস ও তাকে মধ্যরাতে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে কে বা কারা উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর পাঁচ বছরেও তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আট বছরের চাঁদনী এখন বাবার দেওয়া খেলনাগুলো কোলে নিয়ে নীরবে সময় কাটায়। মা ও দাদুর কাছে কেবলই জানতে চায়, ফিরবে কবে বাবা? আনসারের গ্রাম বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নের গুমরাগুলে যখন যাওয়া হয় তখন ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরেন আনসারের মা নূরজাহান বেগম। সংবাদকর্মীদের দেখে শিশুদের মতো কান্না জুড়ে দেন তিনি। আমার ছেলের কোনো খবর তোমাদের কাছে আছে কি? বলেই কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, পাঁচ বছরেও ছেলের খোঁজ পেলাম না। আমাদের অচল সংসার। অকালেই নিভে গেল আমার আশার প্রদীপ। মনের ব্যথা ভর করেছে শরীরে। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও হার্টের অসুখে ভুগছি। মৃত্যুর আগে ছেলের খোঁজ পেয়ে মরতে চাই। এদিকে স্বামী নিখোঁজের দুর্বিষহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম। স্থানীয় একাডেমিতে এখন শিক্ষকতা করেন তিনি। ওই একাডেমিতে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে চাঁদনী। তিনি বলেন, চাঁদনী সব সময় তার বাবা সম্পর্কে জানতে চায়। উত্তরে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না। দেশবাসীর কাছে আমাদের প্রশ্ন— এভাবে আর কত দিন অতিবাহিত করব আমরা?প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি : নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা সভাপতি এম ইলিয়াস আলীর সন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করেন জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা। স্মারকলিপি গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়— রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। আমাদের বিশ্বাস সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে গুম হওয়া সব নাগরিকদের তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। অবিলম্বে এম ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয় স্মারকলিপিতে। এ সময় জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ, মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমসহ বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।