শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

তবু থামেনি অ্যাসিড সন্ত্রাস

বিচারের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর না হওয়া, অ্যাসিডের সহজলভ্যতা দায়ী

জিন্নাতুন নূর

তবু থামেনি অ্যাসিড সন্ত্রাস

দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা অতীতের চেয়ে কমে এলেও থামানো যাচ্ছে না। অথচ অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইনে এই অপরাধের জন্য আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু বিচারের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর না হওয়া, কিছু ক্ষেত্রে অ্যাসিডের সহজলভ্যতার জন্য এখনো এই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা ভিকটিমের কাছের মানুষ বা পরিচিত। এক্ষেত্রে পারিবারিক কলহের জেরে অনেক স্বামী তার স্ত্রীর ওপর অ্যাসিড ছুড়েন। কিছু ক্ষেত্রে যৌতুক না দিলেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন গৃহবধূদের অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। আবার সম্পত্তির বনিবনা না হওয়ায় ভাই ও আত্মীয়রাও অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটান। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ঘটনায়ও বখাটেরা কিশোরী ও তরুণীদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে অ্যাসিড সন্ত্রাস কমেছে। তারা আশা করছেন, বাংলাদেশ থেকে এই ঘৃণ্য অপরাধ নির্মূল হবে। তারা বলেন, অ্যাসিডের সহজলভ্যতা, অপরাধীদের মনমানসিকতার জন্য এই অপরাধ কমানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া অপরাধ সংঘটিত করে তার প্রমাণাদিও অপরাধীরা নষ্ট করে ফেলছে। যদি অ্যাসিড সন্ত্রাসের মামলাগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্টদের সহমর্মিতা থাকে তবে তা কমে আসবে। পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের অধীন গঠিত অ্যাসিড অপরাধ দমন মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা দেশে মোট ২ হাজার ১৯টি মামলা হয়। যার মধ্যে ১৮৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ৩২৫ জনের। যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন ১১৭ জন। আর ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। তবে এসব মৃত্যুদণ্ডের একটি রায়ও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অনেকে আপিল করেছেন, কেউ পালিয়ে আছেন। মূলত সাক্ষীর অভাবে অনেক আসামিরই সাজা হচ্ছে না। দণ্ডপ্রাপ্তদের কে কোথায় আছে তা জানতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে। অ্যাসিড সারভাইবারস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিষয়টি নিশ্চিত করা না হয় ততক্ষণ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না। যদি নিম্ন আদালতে আসামির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া থাকে তবে উচ্চ আদালতে এর নিশ্চয়ই আপিল হয়েছে। আর অনেকেই নিম্ন আদালতে রিভিউ করেন। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আর মামলাটি যদি সুপ্রিম কোর্টে থাকে আর এর রিভিউ হয় তবে এই মামলার রায় কার্যকরে সাত দিনও লাগার কথা নয়। এ জন্য সরকারকে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে। অনেক সময় বিশেষ ক্ষেত্রে অনেকে রিভিউ করেন। আর নিম্ন আদালতে যে রায় হয় তা কার্যকর হতে সময় লাগে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করায় অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূল করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এই অপরাধের বিচার ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা থাকলেও মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রতার জন্য বিচার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না। জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল এমডিজি অর্জনে ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাসিড সহিংসতায় আক্রান্তের সংখ্যা বছরে ৫০-এ সীমাবদ্ধ রাখার জন্য কাজ করলেও তা সম্ভব হয়নি। সে বছর অ্যাসিড নিক্ষেপে ৭৪ জন দগ্ধ হন। অ্যাসিড ভিকটিমদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের হিসাবে এক দশক আগেও ২০০৬ সালে ১৮৩টি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনায় ২২৪ জন আক্রান্ত হন। আর ২০১৬ সালে তা চারগুণের বেশি কমে ৪৪-এ নেমে আসে। এ সময় মোট ৫০ জন অ্যাসিড দগ্ধ হন। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। এতে ১০ জন অ্যাসিড দগ্ধ হন। অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে দেশে ২০০২ সালের অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন হয়। পরে ২০১০ সালে সংশোধন করে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন হয়। আইনে অ্যাসিড নিক্ষেপে ভিকটিমের মৃত্যু হলে অপরাধীর জন্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের কো-চেয়ারম্যান মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমরা শুনেছি অ্যাসিড হামলার ঘটনায় ১৪ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে। যার একটি রায়ও কার্যকর হয়নি। এতে কেন দেরি হচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজ নেবেন বলে প্রতিমন্ত্রী জানান। তবে এই অপরাধ কমে আসার বিষয়টিকে সমাজের ইতিবাচক দিক বলে তিনি মনে করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, অ্যাসিড নিক্ষেপের ফলে মানুষের ত্বকের টিস্যু গলে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানের হাড় বেরিয়ে আসে। আর চোখে অ্যাসিড পড়লে তা স্থায়ী অন্ধত্ব ডেকে আনে। এটি শুধুই একজনের চামড়ার ক্ষতি করে না মানসিকভাবে ভিকটিমকে দুর্বল করে ফেলে। আক্রান্ত ব্যক্তি অস্তিত্ব সংকটে ভোগেন। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অবিবাহিত অ্যাসিড আক্রান্তদের সিংহভাগেরই বিয়ে হয় না। আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর অর্থনৈতিক চাপ পড়ে। তারা অন্যের সহযোগিতা ছাড়া কাজ করতে পারেন না।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। এই নারীদের বয়স সাধারণত ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। কিছু ক্ষেত্রে সম্পত্তি ও পূর্বশত্রুতার জেরে পুরুষরাও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন। আর মোট ভিকটিমের চারভাগের এক ভাগ শিশু। এক্ষেত্রে শিশুরা মায়ের কাছাকাছি থাকায় তারাও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে ১৫%-ই প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায়, ১০% শত্রুতার কারণে এবং ০৫% যৌতুক ও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি না দেওয়ায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে উল্লাস নামের দুর্বৃত্ত। এতে সেই ছাত্রীর মুখমণ্ডল ঝলসে যায়। এমনকি তার মায়ের শরীরও অ্যাসিডে আংশিক ঝলসে যায়। এ বছরই প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় নবম শ্রেণির আরেক ছাত্রীকে বখাটে সেলিম অ্যাসিড ছুড়ে মারে। রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে স্ত্রী মাহফুজা আক্তারকে চাকরি করতে নিষেধ করেছিলেন স্বামী সুরুজ আলী খান। অমান্য করায় চলতি বছরই টাকা দিয়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়োগ করে স্ত্রীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটান তিনি।

সর্বশেষ খবর