শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সোচ্চার হচ্ছে কিশোরীরা এগিয়ে আসছে সমাজও

বাল্যবিবাহ রোধ

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে যেসব সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাল্যবিবাহ। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনাসহ বাল্যবিবাহের কারণ চিহ্নিত করতে সরকার কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এজন্য দরকার এ বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা এবং মেয়েদের শিক্ষাসহ দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে এরই মধ্যে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেছে দেশের মেয়েরা। এজন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশি মেয়ে শারমিন আক্তারের সাহসী ভূমিকা প্রশংসিতও হয়েছে। শারমিনের মতো জেলায় জেলায় অন্য মেয়েরাও নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধে সাহসী হচ্ছে। আর এই মেয়েদের সাহায্য করতে এবং দেশব্যাপী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছে। সম্প্রতি নিজের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ ২০১৭ পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের ঝালকাঠির মেয়ে শারমিন আক্তার। রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে মার্কিন দূতাবাসের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শারমিন জানায়, মেয়েরা বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ সাহায্য করবে। আর পুলিশ না করলে শিক্ষক, সহপাঠী বা অন্য কেউ করবে। এসএসসি পরীক্ষার্থী শারমিন জানায়, ২০১৫ সালে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন তার মা তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। শারমিন তার এক বান্ধবী ও স্থানীয় সাংবাদিকের সহযোগিতায় থানায় গিয়ে তার মা ও কথিত স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। যদিও সে সময় মেয়েটির বাবা কবির হোসেন সৌদিতে ছিলেন। শারমিন এখন তার দাদি দেলোয়ারা বেগমের সঙ্গে থাকে। ময়মনসিংহের ত্রিশালের বৈলর বাশখুড়ি গ্রামের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (১৩)। উজানপাড়া এতিমখানা আলিয়া মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী মাদ্রাসার অ্যাসেম্বলির ক্যাপ্টেন। প্রতিদিন অ্যাসেম্বলিতে শপথ পড়ার সময় বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলার শপথ উচ্চারণ করা মেয়েটি এবার নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে। দরিদ্র পরিবারের মেয়েটিকে তার অভিভাবকরা বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এজন্য পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল সোনিয়া। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সে তার মাদ্রাসা শিক্ষক আবুল মুনসুরকে ফোনে বিষয়টি জানায়। এরপর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ওসমান গনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু জাফর রিপনকে বিষয়টি জানালে তিনি সোনিয়াকে ইউএনও কার্যালয়ে নিয়ে যান। এরপর সোনিয়ার বাবা আনিসুর রহমানকে সেখানে ডেকে পুলিশের উপস্থিতিতে সোনিয়ার বাল্যবিবাহ ভেঙে দেওয়া হয়। ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একদল ছাত্রী সম্প্রতি সম্মিলিতভাবে পৌর শহরের দশালিয়া গ্রামে দলবেঁধে এক কিশোরী কনের বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হয়ে বিয়ে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। কিশোরী দলটি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি জানিয়ে এই সাহসী কাজ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখা গত তিন বছরে প্রায় দুই হাজার বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। এজন্য বাল্যবিবাহ আইন নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলেছেন প্ল্যানের স্থানীয় কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সংস্থাটি। প্ল্যানের জন্য দেশের অনেক এলাকা এখন বাল্যবিবাহ মুক্ত হিসেবে পরিচিত। প্ল্যান দেশের সাত লাখ কিশোর-কিশোরীকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করেছে। এজন্য মেয়েদের জীবন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, আত্মরক্ষার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্ল্যান বাংলাদেশের ‘ওয়েডিং বাস্টারস’ নামক দলটি এখন কাজ করছে। আর সে দলে আছে কিশোর-কিশোরীরাও। দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন নামের কিশোরীদের ক্লাবও কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার স্কুলের মেয়েরা নিয়মিত বৈঠক করে স্বাস্থ্যগত সমস্যার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে আলোচনা করে। স্বর্ণকিশোরীর পক্ষ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। যার ২৪ ঘণ্টাব্যাপী হটলাইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। ২০১৮ সালের মধ্যে এই ক্লাব দেশের দুই কোটি কিশোরীর কাছে সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। জানা যায়, প্রতি এলাকায় এই ক্লাবের একজন নেটওয়ার্ক চিফ থাকে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সেই নেটওয়ার্ক চিফরা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন। সামাজিক এই সমস্যার বিরুদ্ধে কাজ করছেন মিনারা বেগম। প্রতিদিনই গাইবান্ধার মিনারা গ্রামের মেঠোপথে নিজেই সাইকেল চালিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি কিশোরী মেয়েদের অভিভাবকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আলোচনাও করছেন। মিনারা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে বাল্যবিবাহের জন্য একটি কিশোরী কী ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয় তা তুলে ধরেন। যদিও কাজটি করতে গিয়ে অনেক সময় মিনারাকে অভিভাবকদের গালমন্দ শুনতে হয়। কিন্তু তারপরও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। মিনারা সরাসরি ২০টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। এছাড়া তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আরও অনেক বাল্যবিবাহ থেমে গেছে। প্রতি সপ্তাহে কিশোরী ও নারীদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন মিনারা। প্রয়োজনে তাদের আইনি সহযোগিতাও দেন। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮ বছরের আগে দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ৭২টি এলাকা যেখানে বাল্যবিবাহ বেশি হয় সেখানকার নয় হাজার মেয়ের ওপর এই জরিপ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ‘বালিকা প্রকল্প’ নামে ইউনিসেফের একটি উদ্যোগে দেশের মেয়েরা শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। ১৮ মাসব্যাপী বালিকা প্রকল্পের মাধ্যমে এটি জানা যায় যে, যে মেয়েরা শিক্ষা ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের ৩১ শতাংশই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। এই প্রকল্পের প্রধান গবেষক সাজেদা আমিন বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দেশের মেয়েদের ক্ষমতায়ন দরকার। এর ফলে মেয়েটির পরিবার ও সমাজ তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। এজন্য জেলা, উপজেলা, থানা পর্যায়ে কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে। এমনকি যারা বাল্যবিবাহ বন্ধ করবেন, তাদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর