মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্ধ হয়নি রিং বাণিজ্য

কোনো হাসপাতালে নেই মূল্য তালিকা

মাহবুব মমতাজী

বন্ধ হয়নি রিং বাণিজ্য

হৃদরোগ চিকিৎসায় জীবন রক্ষাকারী করোনারি স্ট্যান্ট বা রিং প্রতিস্থাপনে নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার রিংয়ের মূল্য তালিকা টানানোর সিদ্ধান্ত হলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত তা টানানো হয়নি অধিকাংশ হাসপাতালে। বিভিন্ন হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক ও মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ও রিং আমদানিকারকদের যোগসাজশে নৈরাজ্য চলছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ঘোষিত হৃদরোগের অপারেশনে ব্যবহূত রিংয়ের মার্কআপের (নির্ধারিত সীমা) মূল্য তালিকা না টানিয়ে আগের মতোই টাকা আদায় করা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর স্বজনই জানে না রিংয়ের নতুন মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, ‘আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেছে।’ রিং আমদানিকারকরা জানান, তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানি ও বিক্রিতে কর দিতে হয় যে কারণে রিংয়ের মূল্য চড়া থাকে। আমদানিকারকরা যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক নয় বলে জানিয়েছে কাস্টমস কর্মকর্তারা।

আসাদ নামে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক রোগীর স্বজন জানান, শুনেছিলাম মূল্য তালিকা টানানোর কথা কিন্তু রিসেপশন, বহির্বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার ও হাসপাতাল অফিসের কোথাও কোনো তালিকা খুঁজে পাইনি।

একই হাসপাতালে ভর্তি থাকা লুত্ফর রহমানের বয়স ৩৫ বছর। তিনি প্রায় পাঁচ বছর সৌদিতে ছিলেন। গত দেড় বছর ধরে তার হৃদরোগের সমস্যা দেখা

দেয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ভর্তি হন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে তার অপারেশনের কথা রয়েছে। এর খরচ সম্পর্কে তিনি তেমন জানেন না, সেটি তার বাবা ভালো জানেন। তবে লাখের বেশি খরচের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তার হার্টে কি রিং লাগবে এবং তার মূল্য সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। রবিবার একই হাসপাতালে অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয় জান্নাতুল ফেরদৌস মাওয়া নামে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া রেলস্টেশন সংলগ্ন। তার বাবা আকমল হোসেন জানান, গত কয়েক বছর ধরে তার মেয়ের হৃদরোগের সমস্যা ছিল। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারেননি। মেয়ের হার্ট অপারেশনে রিংয়ের মূল্য তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। সব খরচ মিলে তা দেড় লাখে যেতে পারে।  ওই রিং বাইয়ো কার্ড লিমিটেডের সেলস এক্সিকিউটিভ মো. নুরুল আমিন শিপনের কাছ থেকে নিয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে শিপন এ প্রতিবেদকের কাছে রিং বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং বলেন তারা হার্টের ভাল্ব সরবরাহ করেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান রবিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে করোনারি স্ট্যান্ট কিংবা হার্টের রিংয়ের মূল্য ঠিক করেছি। সব হাসপাতাল তা এখন অনুসরণ করবে। যারা করবে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ১৫টি আমদানিকারকের ৩৭টি ব্র্যান্ডের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি। 

অভিযোগ রয়েছে, হার্ট অপারেশনে রিং লাগবে কিনা এবং কোন রিং লাগানো হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট রোগী কিংবা তার স্বজনকে জানানো হয় না। অপারেশন শেষে রোগীকে যখন হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয় তখন মোটা অঙ্কের বিল-ভাউচার ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অসাধু আমদানিকারক এবং কমিশন পাওয়া কিছু চিকিৎসক জড়িত থাকেন।

নগরীর কলেজগেট জামে মসজিদ সংলগ্ন এসবি ফার্মা নামে এক ওষুধের দোকানের কর্মচারী জানান, হার্টের রিং ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় না। এটা চিকিৎসকের কাছে পাওয়া যায়। তারা আমদানিকারকের কাছ থেকে নিয়ে তার অধীনস্থ রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। এতে তো বাণিজ্যিক বিষয় জড়িত অবশ্যই থাকে। অথচ রবিবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমরা ওষুধ প্রশাসনের নির্ধারিত মূল্য তালিকা হাতে পেয়ে গেছি। কাল (সোমবার) সর্বত্র টানিয়ে দেওয়া হবে এবং চিকিৎসকের মাধ্যমে রোগীকে সে সম্পর্কে ব্রিফ করে জানিয়ে দেওয়া হবে। হার্টের রিং নিয়ে আর যেন ছলচাতুরি না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ কিন্তু সে হাসপাতালে মূল্য তালিকা না টানানোর বিষয়ে গতকাল সোমবারও তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি তা ধরেননি।  জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে রিংয়ের মূল্য তালিকা টানানোর ব্যবস্থা করা হলেও বেসরকারি হাসপাতাল ইউনাইটেড, স্কয়ার, এ্যাপোলো ও ল্যাবএইড সে অনুযায়ী রিংয়ের মূল্য নিতে রাজি হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল্য তালিকা টানানো হয়নি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। আর মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ও চার্জ দেওয়ার কারণে রিংয়ের দাম বেশি হয়। তারা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রস্তাবিত মূল্য তালিকা না মেনে ১৯৫.৮৯ শতাংশ মার্কআপ (মূল্য সীমা) দিয়ে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। যেখানে বিদেশি চার্জ দেখানো হয়েছে ৪ শতাংশ, ইনসুরেন্স ২ শতাংশ, এল/সি কমিশন ১ শতাংশ, এটিভি ৪ শতাংশ, ফরেইন ব্যাংক চার্জ ১ শতাংশ, সিএন্ডএফ চার্জ ৭ শতাংশ ফান্ড কোস্ট ১২ শতাংশ, ইমপোর্ট মার্জিন ১২.৫ শতাংশ, ডিসটিবিউশন কোস্ট ২৫ শতাংশ এবং হসপিটাল সার্ভিস চার্জ ১৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ঢাকা কাস্টমস কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, হার্টের রিংয়ের ক্ষেত্রে এটিভি ৪ শতাংশ ছাড়া আর কোনো ভ্যাট/ট্যাক্স নেই। অভিযোগ রয়েছে, আমদানিকারকরা বিলাসী হাসপাতালের খরচ অনুযায়ী তাদের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। একই খরচ তারা ছোট-খাটো হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করবে। এমন হিসাব দেখিয়ে এখনো ইচ্ছামতো দাম ধরছে আমদানিকারকরা। রিং বিক্রিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর আমদানিকারকদের ২২ শতাংশ লভ্যাংশের কথা বলেছেন, কিন্তু তারা ২২ শতাংশের বেশি নিতে চান। রিং বিক্রিতে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ার বিষয়ে মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি গাজী এ কে শাহীন জানান, ‘আগে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া ছিল না। এখন হয়েছে আমরা কর্তৃপক্ষের তালিকা অনুযায়ী মূল্য নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি। ওনারা ২২ শতাংশের যে লভ্যাংশের কথা বলেছেন সেটা মেনে নেওয়া যাবে না, কারণ তারা অনেকগুলো ফ্যাক্টর বাদ দিয়েছেন। দর কষাকষি চলছে পরে তা বাড়তেও পারে।’

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবির ভূঁঞা বলেন, আমদানিকারকরা অনেক ধরনের করের কথা বলে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে রোগীদের কাছ থেকে চড়া মূল্য নিচ্ছেন। এখনো তারা ওষুধ প্রশাসনের নির্ধারিত মার্কআপ মেনে নিতে চাচ্ছেন না। তারা ইউনাইটেড হসপিটালে যে খরচ হবে সে অনুসারে সাধারণ হাসপাতালের রোগীর কাছ থেকেও টাকা আদায় করার পাঁয়তারা করছে।  ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. রুহুল আমীন জানান, সরকারি হাসপাতালগুলোর সাধারণ চার্জ দুই হাজার টাকা। রিংয়ের যে মূল্য তালিকা দেওয়া হয়েছে তা অনুসরণ করতেই হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্ধারিত মূল্যটি গুণগত মান অনুসারে ২৫ হাজার থেকে শুরু করে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর