শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

কেমন আছেন রানা প্লাজায় পঙ্গু হওয়া হতভাগ্য শ্রমিকরা

নাজমুল হুদা, সাভার

কেমন আছেন রানা প্লাজায় পঙ্গু হওয়া হতভাগ্য শ্রমিকরা

সাভারে বিধ্বস্ত সেই রানা প্লাজা প্রাঙ্গণে গতকাল কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রিয়জন হারানো মানুষগুলো —রোহেত রাজীব

‘চোখ মেলেই দেখি ঘোর অন্ধকার। দিন না রাত বুঝতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে অনেক মানুষের চিৎকার আর মাইকের শব্দ পাচ্ছিলাম। এক সময় টর্চলাইটের আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু গলা শুকিয়ে যাওয়ায় কথা বলতে পারছিলাম না। পানির পিপাসায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বাম হাতটা আটকে গিয়েছিল পিলারের নিচে। সামান্য নড়াচড়াও করা যাচ্ছিল না। তবু  বার বার মনে হচ্ছিল এ যাত্রায় বুঝি বেঁচে যাব। এক সময় সে আশাটুকুও কমে আসতে থাকে। দুই দিন দুই রাত পর কে যেন পায়ের পাতায় একটা ঝাঁকুনি দেয়, আর চিৎকার করতে থাকে-কেউ কি বেঁচে আছেন এখানে? ডান পা একটু নাড়াতেই মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন মানুষের মুখ দেখতে পাই।’ রানা প্লাজার মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসার কাহিনী বলতে গিয়ে একপর্যায়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শিল্পী রানী দাস। আবারও বলতে শুরু করেন তিনি, ‘আমাকে উদ্ধারের জন্য কতজন যে চেষ্টা করেছিল, তা বলতে পারব না। কতভাবেই না চেষ্টা করতে থাকে তারা। তবুও আমাকে বের করা যাচ্ছিল না হাতটা আটকে থাকার জন্য। এক সময় নিজেই তাদের বলি, আমাকে একটা করাত দেন। একজন একটি করাত এনে দেয়। করাত দিয়ে আস্তে আস্তে নিজেই হাতটা কেটে বিচ্ছিন্ন করলাম। এরপর উদ্ধারকর্মীরা আমাকে বের করে নিয়ে আসে। তারপর আর কিছু মনে নাই।’ তিনি বলেন, ‘ওভাবে আটকে থাকার পরও আমার বার বার মনে হচ্ছিল ছোট বোন শিপু রানী দাসের কথা। আমরা দুই বোন পাশাপাশি কাজ করতাম। ভবন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তখন শুধু মর্জিনার কথাই মনে পড়তে থাকে। ও কি বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই ভাবতে থাকি। আমি বেঁচে ফিরলেও তাকে আর খুঁজে পাইনি। কিছু দিন আগে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে মর্জিনার লাশ শনাক্ত হয়েছে। তবে তার লাশ পাইনি, পেয়েছি কবর।’ শিল্পী জানান, খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামীর একার উপার্জনের টাকায় ঠিকমতো সংসার চলছিল না। একটু সচ্ছলতার মুখ দেখতে রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় চাকরি নেন তিনি। শতকষ্টের মাঝেও সংসার গোছানোর স্বপ্নটা অল্প অল্প করে এগোচ্ছিল তাদের। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেছে তার সেই স্বপ্ন। পঙ্গুত্ব নিয়েই এখন জীবন কাটছে শিল্পী রানী দাসের। রানা প্লাজার আরেক আহত শ্রমিক সাদ্দাম হোসেন লস্কর। বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মসদই গ্রামে। রানা প্লাজার পাশের ভবনে একটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন তিনি। রানা প্লাজা ধসে পড়েছিল সেই ভবনের ওপর। সেখানেও মারা গেছেন কয়েকজন। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু আহতাবস্থায় কেটে ফেলতে হয়েছে তার একটি হাত। এখনো তিনি সাভারের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতি মাসে চিকিৎসা নিতে আসেন। সাদ্দাম জানান, ‘নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পেলেও তা দিয়ে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। দেড় মাস চিকিৎসা শেষে বিদেশি একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে তাকে একটি কৃত্রিম হাত দেওয়া হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আমজাদের দুটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তিনি দেড় বছর সাভারের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) চিকিৎসা নিয়ে সাভারের বক্তারপুর মহল্লার ভাড়া বাড়িতে ফিরেছেন। এরপর থেকে আর কেউ খোঁজ নেয়নি তার। আমজাদ বলেন, ‘চলতে ফিরতে পারছি না। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছি। এ বয়সে পরিবারকে আমারই সহযোগিতা করার কথা। অথচ আমি এখন তাদের সহযোগিতায় বেঁচে আছি। এদিকে আহত পঙ্গুদের চাকরির দায়িত্ব নিলেন সাভার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওবায়দুর রহমান অভি। তিনি বলেন, রানা প্লাজার সামনে গিয়ে করুণ কাহিনী দেখে তিনি নিজে বাছাই করে তার নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেন পঙ্গুদের।

সর্বশেষ খবর