বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্ভোগ কাটছে না হাওরে

ফসলহারা মানুষের স্রোত ন্যায্যমূল্যের দোকানে

প্রতিদিন ডেস্ক

দুর্ভোগ কাটছে না হাওরে

পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে ফসলি জমির বোরো ধান পানির নিচে তলিযে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষক। সুনামগঞ্জের তাহেরপুর থেকে তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সুনামগঞ্জের হাওরের ৯০ ভাগেরও বেশি ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কম দামে সংগ্রহের জন্য ফসলহারা মানুষের স্রোত এসে ঠেকেছে ন্যায্য মূল্যের (ওএমএস) চাল, আটার দোকানে। বিভিন্ন সংগঠন বন্যাকবলিত হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে কিশোরগঞ্জে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এদিকে, হাওর হাকালুকিতে অকাল বন্যায় ধান পচে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেখা দেয় মাছের মড়ক। মাছ ধরা এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর সোমবার থেকে আবারও হাওরে মাছ ধরতে দেখা গেছে অনেক জেলেকে।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—সুনামগঞ্জ : হাওরের ৯০ ভাগেরও বেশি ফসল তলিয়ে যাওয়ায় দুমুঠো খাবার কম দামে সংগ্রহের জন্য ফসলহারা মানুষের স্রোত এসে ঠেকেছে খাদ্য বিভাগের ন্যায্য মূল্যের (ওএমএস) চাল, আটার দোকানে। চাহিদার তুলনায় দোকানের সংখ্যা ও বরাদ্দ কম থাকায় ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও চাল-আটা না পেয়ে বেশির ভাগ মানুষকে ফেরত যেতে হচ্ছে খালি হাতে। ন্যায্য মূল্যের দোকানে আসা ক্রেতারা জানান, পাঁচ কেজি চাল কিংবা আটার জন্য দুই-তিন দিন ধরে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরও সরকারি বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাড়ি ফিরছেন খালি হাতে। ফেরত যাওয়া মানুষের অনেকেই এসেছেন ১০/১৫ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দিয়ে। লাইনে দাঁড়ানো কোনো কোনো নারী এসেছেন দুধের শিশু কোলে নিয়ে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ব্যক্তি থেকে শুরু করে স্কুলশিক্ষার্থী—সবাই ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন চাল কিংবা আটার জন্য। তাদের ডাক পড়ার আগ পর্যন্ত। ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর হাওর অধ্যুষিত জেলায় খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আগে আগামী বোরো ফসল তোলার আগ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের খাবারসহ সব ধরনের সহায়তা প্রদানের দাবি করছেন ফসলহারা মানুষ। সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের গৃহিণী রুবিনা বেগম বলেন, ‘২২ দিনের শিশুকে লগে লইয়া ন্যায্য মূল্যের দোকানও পাঁচ কেজি চাউল কিনতাম আইছি। বিয়ানিবেলা আইছিলাম অনে দুপুর অইলেও শেষ পর্যন্ত পাইমু কি না জানি না।’ জলিলপুর গ্রামের আইরুন নেছা বলেন, ‘বাজারে চাউলের যে দাম এই দামে কিনার সামর্থ্য নাই। এর লাগি লাইনে দাঁড়াইয়া ঠেলাঠেলি সহ্য কইরা চাউল কিনতাম আইছি। এর আগেও দুই দিন আইয়া না ফাইয়া ঘুইরা গেছি। জানি না আইজও কপালে ঝুটব কি না।’ জেলা প্রশাসন জানায়, জেলার তিন লক্ষাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য এ পর্যন্ত জেনারেল রিলিফ (জিআর) ফান্ড থেকে ১১ উপজেলায় এক হাজার মেট্রিক টন চাল, নগদ ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১৫৫ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। আগামী তিন মাস ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লাখ পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০ টাকা সহায়তা দেবে সরকার। এদিকে, তিন মাসের বিশেষ সহায়তা প্রদানে উপকারভোগীদের তালিকায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রাধান্য না দিয়ে উপজেলাওয়ারি জনসংখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করায় ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর খবরে হতাশ হয়েছেন ফসলহারা কৃষকরা। কৃষকদের দাবি, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় না এনে জনসংখ্যার অনুপাতে হাওর, সমতল ও পৌর এলাকাকে একাকার করে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানোর কারণে সরকারি সহায়তা হাওরে ফসলহারা মানুষের খুব কমই উপকারে আসবে। গতকাল এ সংক্রান্ত খবরটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফয়েজুর রহমান বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলেও গতকাল জানান, কৃষি বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় এনে এ তালিকা করা হয়েছে। এটি আপাতত পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাধান্য না দিয়ে যারা তালিকা করে উপরে পাঠিয়েছেন তারা দায়সারা কাজ করেছেন। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত করে তালিকাটি পুনরায় করার জোর দাবি জানাচ্ছি। কিশোরগঞ্জ : বন্যাকবলিত হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সিপিবি ও বাসদ। গতকাল দুপুরে শহরের স্টেশন সড়কে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন থেকে বক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও বর্গাচাষিদের ক্ষতিপূরণ, কৃষি ও এনজিও ঋণ মওকুফ করে নতুন করে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার দাবি জানান। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহেরও দাবি জানানো হয়। এদিকে, হাওর উপজেলা নিকলীতে বন্যায় ফসলহানির পর নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে ধানে চারা গজানো এবং বাদামে পচন ধরা। টানা বৃষ্টির কারণে ধান শুকানো যাচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে স্তূপ করে রাখা ধানে চারা গজাচ্ছে। আর বাদামে ধরেছে পচন। এ অবস্থায় কৃষকের মাঝে বিরাজ করছে হতাশা। মৌলভীবাজার : এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে অকাল বন্যায় ধান পচে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেখা দেয় মাছের মড়ক। এতে মারা যায় হাওরের ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এক সপ্তাহ বন্ধ ছিল হাওরে মাছ ধরা। ২৩ এপ্রিল ঢাকা মৎস্য অধিদফতরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিদর্শক মেরিনা পারভীন সরেজমিন হাকালুকি হাওর পরিদর্শন করে মাটি ও পানি পরীক্ষা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে জানান। সোমবার থেকে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অনুমতি দেয় মৎস্য বিভাগ। এতে বেকার মৎস্যজীবীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে এবং গতকাল হাওরে মাছ ধরতে দেখা গেছে অনেক জেলেকে। নেত্রকোনা : বারহাট্টা ও মদন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণকালে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তাদের পাশে সরকার রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার জনবান্ধব সরকার। কৃষকবান্ধব সরকার। আমরা ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং নগদ ৫০০ করে টাকা বিতরণ করব।

 কৃষি ঋণের সুদ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় চিরাম তাহেরা মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল মাঠে আয়োজিত সমাবেশে স্থানীয়দের হাতে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ত্রাণ তুলে দেন। প্রতি পরিবারকে ৩০ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা বিতরণ করা হয়। পরে বিকালে মদন উপজেলার উচিতপুর ঘাটে ত্রাণ বিতরণ সমাবেশে প্রতি পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০ টাকা তুলে দেন। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল, জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান প্রমুখ। পরে স্পিডবোটে করে মন্ত্রী হাওরের একাংশ পরিদর্শন করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর