বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

দূষণ-দুর্নীতির নগরী নারায়ণগঞ্জ

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

দূষণ-দুর্নীতির নগরী নারায়ণগঞ্জ

চাষাঢ়া থেকে জিমখানা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তার বিভিন্ন স্পটে সারা দিন পড়ে থাকে ময়লার স্তূপ। পাড়া-মহল্লার অলিগলির রাস্তায়ও রয়েছে অনির্ধারিত অসংখ্য ডাস্টবিন। কালীবাজার গ্রিন্ডল্যাজ ব্যাংকের মোড়, অক্টোফিস, জামতলা, নূর মসজিদের বিপরীত পাশসহ বিভিন্ন স্থানে দিনের বেলায়ও দেখা গেল রাস্তার পাশে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। ভন ভন করছে মাছি। বেওয়ারিশ কুকুর ওই ময়লায় মাথা ঢুকিয়ে খুঁজছে খাবার। কুকুরগুলো ময়লার পলিথিন টেনে নিয়ে আসছে রাস্তার মাঝ পর্যন্ত। এতে ময়লা পলিথিন ছিঁড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মানুষজন নাকে রুমাল চেপে রাস্তায় যাতায়াত করছেন। পৃথিবীর দূষিত ২০টি শহরের মধ্যে ১৭তম দূষিত নগরী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এলাকার এখন এমনই দশা। অল্প বৃষ্টিতে শহরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। শিল্প-বাণিজ্যে অবদান রাখলেও নাগরিক সেবা এখানে অপ্রতুল। অভিযোগ রয়েছে, গত    ১২ বছরে ৫০০ কোটি টাকার টেন্ডার দুর্নীতি হয়েছে অসহনীয় যানজটের জন্য আলোচিত এই নগরীতে। এখানকার সংসদ সদস্য হলেন শামীম ওসমান এবং সিটি মেয়র হলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এলাকাবাসী মনে করেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে নেতারা একযোগে কাজ করলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে এখনো উন্নয়নের রোল মডেল করা যেতে পারে। সিটি করপোরেশন উন্নয়ন ও নানা নাগরিক সেবার বঞ্চনা নিয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, নির্বাচনের পর নাসিক নিয়ে জনগণের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল তা পূরণ হয়নি। গত সিটি নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নাসিকের শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ দুদুকে চলমান। সে ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জে সরকার দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করছে। আমি মেয়র হলে এতদিনে আমাকে জেলে পুরে দেওয়া হতো। এসব দুর্নীতির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক জীবন কৃষ্ণ মোদক জানান, ‘উন্নয়নের স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে বৃহত্তর স্বার্থ উদ্ধারে নারায়ণগঞ্জের সব জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক টেবিলে বসতে হবে। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে। নইলে ভালো উদ্যোগও ভেস্তে যাবে।’

নাগরিক ক্ষোভ-অভিযোগ : ১২ নং ওয়ার্ড ফতুল্লার ইসদাইর বাজারের আহসান ভিলার মালিক এনামুল হক জানান, প্রতি বছর ‘আলো ও ময়লা কর’ সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৮ হাজার টাকা কর নিচ্ছে। সড়কে কোনো কোনো খুঁটিতে বাতি থাকলেও তা জ্বলছে না দীর্ঘদিন। নাসিক এগুলো সংস্কারও করছে না। ময়লা কর নিলেও এলাকায় নেই কোনো নির্দিষ্ট ডাস্টবিন। ব্যক্তি উদ্যোগে ময়লা লোকজন এসে ময়লা নিয়ে যায়।

দুর্নীতির নানা অভিযোগ : দুর্নীতির নানা অভিযোগ আছে নাসিকের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এসব দুর্নীতির অভিযোগ গড়িয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে দুদুক পর্যন্ত। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ মিললেও দুর্নীতির ফাইল এখন লাল ফিতায় বন্দী।

টেন্ডার দুর্নীতি : অভিযোগ রয়েছে ১২ বছর ধরে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার টেন্ডার দুর্নীতি হয়েছে। পৌরসভা আমল থেকেই নাসিক কর্তাদের ঘনিষ্ঠরা ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকার টেন্ডার কাজ সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়াও সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার টেন্ডার কাজ বরাদ্দ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাথে টাইলস বসানোর কয়েক কোটি টাকার তিনটি কাজও এই সিন্ডিকেটকে দেওয়া হয়েছে এবং প্রকৌশলীদের ধার্যকৃত ৪৩ টাকার টাইলসকে ১১৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। বন্দরে নির্মিতব্য ইকোপার্কের প্রথম ধাপের ৩০ কোটি টাকার সব টেন্ডারও কুক্ষিগত হয়েছে।

দোকান ও ফ্ল্যাটে দুর্নীতি : সাবেক পৌর আমল থেকে বর্তমান সিটি করপোরেশন আমল পর্যন্ত নাসিকের নিজস্ব দোকান ও ফ্ল্যাট নিয়ে হরিলুট চালানো হয়েছে। সাবেক পৌরসভা আমল থেকে নির্মিত বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে দোকান বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে জাতীয় সংসদকে দেওয়া সিটি করপোরেশনের তথ্যপত্রে কমপক্ষে শতাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে—যাদের কোনো ঠিকানাই নেই এবং বেশ কিছুর ঠিকানা থাকলেও অসম্পূর্ণ।

অভিযোগ রয়েছে, এসব নামে-বেনামে দোকান-ফ্ল্যাট বরাদ্দের নামে হরিলুট চালানো হয়েছে এবং সংরক্ষিত কোটার নামে নামমাত্র মূল্যে বহু দোকান ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার নজির পাওয়া গেছে। পরিচিত একটি সিন্ডিকেট এটি করছে। সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন ঠিকাদার আবু সুফিয়ান এবং সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি পরিদর্শক আলমগীর হোসেন হিরণ।

যত্রতত্র ময়লায় সয়লাব : যত্রতত্র ময়লায় সয়লাব নগরী। সামান্য বৃষ্টিতে এই দুর্ভোগ বেড়ে যায় শতগুণ। নারায়ণগঞ্জবাসী যেন এ অবস্থা দেখে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত। নাসিকে ময়লা ফেলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। ফতুল্লার পঞ্চবটীতে যে পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানেই হওয়ার কথা ছিল ড্যাম্পিং স্টেশন। কিন্তু পার্ক দুর্নীতির কারণে সেখানে হয়ে ওঠেনি সেই স্টেশন।

জট খোলে না চিটাগাং রোডের : ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট চিটাগাং রোডে যানজট লেগেই থাকে। শহরের চাষাঢ়া মোড় থেকে জিমখানা পর্যন্ত দেড় থেকে দুই কিলোমিটার রাস্তা রিকশায় যেতে সময় লাগার কথা ৭ থেকে ৮ মিনিট। অথচ এই দূরত্ব পার হতে সময় লেগে যায় আধা ঘণ্টা। অবৈধ রিকশার পাশাপাশি শহরের মার্কেটগুলোতে নেই কোনো পার্কিং জোন। তাই রাস্তার পাশেই পার্কিং করে রাখা হয় নানা যানবাহন।

সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা : মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় মূল শহরের রাস্তার দুদিক। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। সড়কের পাশে থাকা ড্রেন উপচে দুপাশের নর্দমার নোংরা পানি সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবার বর্ষাকালে শহরের সড়কগুলোতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ১২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জানান, শহরের চাষাঢ়াসহ ছয়টি স্পটে জাপানি দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ছয়টি ফুট ওভার ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে। ১৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজল জানান, তার এলাকায় ৩০০ কোটি টাকায় বাবুরাইল লেক নির্মাণ কাজ চলছে। এ ছাড়া দেওভোগ জিমখানা এলাকায় ঢাকার হাতির ঝিলের আদলে ‘বেগম ফজিলাতুন নেছা লেক’ নির্মাণ হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর