শিরোনাম
রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানা ছিল জঙ্গিদের ‘স্টোর হাউস’

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, যে বাড়িতে ‘অপারেশন ঈগল হান্টে’ চারজন নিহত হন, সেই বাড়িটি জঙ্গিরা তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের স্টোর হাউস (ভাণ্ডার) হিসেবে ব্যবহার করত। তিনি গতকাল ঢাকায় তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানা থেকে যেসব বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো দেখে মনে হয়েছে বাইরে থেকে সেগুলো আনা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানাটি নব্য জেএমবি সদস্যদের স্টোর হাউস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তিনি মনে করেন, নিহতদের মধ্যে দুজন আত্মঘাতী হয়েছেন। বাকি দুজন পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে মারা যেতে পারেন। তিনজনের মধ্যে নব্য জেএমবির নেতা আবদুল্লাহ রয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা, যার ঝিনাইদহের বাড়িতে ২২ এপ্রিল অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছিল। নিহতদের দুজন ঝিনাইদহ থেকে থেকে এসেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে সুমাইয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান মনিরুল। তিনি আরও মনে করছেন, ঝিনাইদহ থেকে আসা আবদুল্লাহ ও তার সঙ্গী বিস্ফোরক নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানায় গিয়েছিলেন। খোলা বাজার থেকেই ওইসব বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো খুব শক্তিশালী বা উন্নত এটা বলা যাবে না। তবে সেগুলোর পরিমাণ অনেক বেশি বলে ধ্বংসক্ষমতা বেশি। তিনি উল্লেখ করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানায় যেসব বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তা অন্য কোথাও ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল। জঙ্গিদের অর্থায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, সমমনা কিছু দেশি ও প্রবাসী লোক জঙ্গিদের অর্থের জোগান দিচ্ছে। অর্থায়নের সব কটি উৎস এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত করা যায়নি। যেসব জঙ্গি জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে ঘর ছেড়েছে, তারা সহায়-সম্পত্তি সংগঠনকে বিলিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ চাকরি করে সংগঠনের তহবিল জোগাচ্ছে। তবুও তাদের কারা অর্থ দিচ্ছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অর্থায়নে প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও জেএমবি সদস্যদের জাল মুদ্রা কারবারে যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পাশের একটি দেশের এই জাল মুদ্রাগুলো প্রতিবেশী আরেকটি দেশ থেকে তৈরি হয়ে আসত। জেএমবি সদস্যরা এই মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে অতীতে দেখা গেছে। এসব মুদ্রা পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে সেই প্রতিবেশী দেশের একজন কূটনীতিক প্রত্যাহারও হয়েছেন। সুতরাং জঙ্গিবাদে বিদেশি অর্থায়নের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ একটি দলের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার যে অভিযোগ সরকারদলীয় নেতারা করেছেন সে বিষয়ে সিটিটিসি-প্রধান বলেন, ‘এটা উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে। জঙ্গিদের অনেককে পাওয়া গেছে, যাদের এ ধরনের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার অতীত রয়েছে। যেমন সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত আবু জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবুর পুরো পরিবার ও তার শ্বশুরের পরিবারও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বলা হয়, আবু বিয়ের পর তার স্ত্রীর প্ররোচনায় জঙ্গিবাদে যুক্ত হন।’

বেওয়ারিশ হিসেবে জঙ্গিদের দাফন : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা জঙ্গি আবুসহ চারজনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। গতকাল রাত ২টার দিকে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের উদ্যোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর গোরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। এ সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র সাইদুর রহমানসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সন্ধ্যায় লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে তিনজন বিস্ফোরণে এবং একজন গুলিতে মারা গেছেন বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম জানান। পরে রাত ৯টার দিকে জঙ্গি আবুর চাচা দাবিদার ইয়াসিন আলীর কাছে তার লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। কিন্তু ইয়াসিন আলীর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকায় পরে লাশটি ফেরত নেয় পুলিশ। এদিকে ওসি হাবিবুল ইসলাম হাবিব জানান, এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে শিবগঞ্জ থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে পুলিশ বাদী মামলা করেছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে নিহত জঙ্গি আবু, তার স্ত্রী সুমাইয়া, নিহত তিন অজ্ঞাত জঙ্গিসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে।

বাড়িটিতে তালা : জঙ্গি আবুর কাছে ভাড়া দেওয়া শিবনগরের সাইদুর রহমান জেন্টু বিশ্বাসের বাড়িটিতে তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে পুলিশ। বাড়ির চারদিকে ক্রাইম সিন ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ঘটনাস্থলে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। বাড়িটি একনজর দেখার জন্য গতকালও অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসেন।

পরিবেশ থমথমে : তিন দিনের জঙ্গি অভিযান শেষ হলেও শিবনগরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আশপাশের অনেকেই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, এত দিন ধরে জঙ্গি আবু এলাকায় থেকে মসলা বিক্রেতার আড়ালে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছেন, তা অকল্পনীয়।

আবুর জঙ্গি হওয়া : শিবনগর গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে রফিকুল ইসলাম আবু ওরফে আবুল কালাম আজাদ আবুর ৯ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। এর পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন আবু। এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি তার শ্বশুরবাড়ি পাশের আব্বাস বাজার এলাকায় চলে যান। সেখানেই তার দুই মেয়ে জন্ম নেয়। মাঝেমধ্যে আবু বাড়িতে এলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে তার বনিবনা হতো না। কিছুদিন আগে তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকলেও তার ও তার স্ত্রীর অতিধার্মিকতা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এমন অবস্থায় ফেব্রুয়ারিতে আবু ওই বাড়ি ভাড়া নিয়ে এলাকায় বসবাস শুরু করেন। আবুর চাচি চামেলী বেগম জানান, আবু তার স্ত্রীর সংস্পর্শে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে। তাই তারা এর দায়দায়িত্ব নেবেন না। তবে জঙ্গি আবুর ছোট ভাই সইবুরের স্ত্রী রুনা খাতুন জানিয়েছেন, আবুর স্ত্রী সুমাইয়া ছাড়া তার দুই কন্যাসন্তানকে তারা নিজেদের কাছে রাখতে চান।

শ্বশুর-শাশুড়ি পালিয়ে : আবুর বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলার সময়ই কানসাট ইউনিয়নের আব্বাস বাজার কাইঠাপড়ার বাড়ি থেকে শ্বশুর রুহুল আমিন ও শাশুড়ি বাড়িঘরে তালা দিয়ে সটকে পড়েন। এখনো তারা পালিয়ে আছেন। আশপশের লোকজন জানিয়েছেন, বুধবার সকাল থেকেই ঘরে তালা মেরে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে বাড়ির লোকজন চলে গেছেন।

মাদ্রাসায় পড়তেন আবু ও স্ত্রী : জঙ্গি আবু পাশের ত্রিমোহনী মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে আবু সবার বড়। তিনি মসলার ব্যবসা করতেন। তার ছোট ভাই সইবুর রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। জঙ্গি আবুর স্ত্রী সুমাইয়া স্থানীয় জাইগীর গ্রাম মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সুমাইয়ার চাচাতো ভাই হাবিব। সুমাইয়ারা দুই ভাই-বোন। এর মধ্যে সুমাইয়া বড়। বিয়ের পর সুমাইয়া পাল্টে যান এবং বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতেন না।

এখনো বেহুঁশ আবুর মা : বুধবার আবুর বাড়িতে অভিযান শুরু করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত। সেদিন থেকেই আবুর মা ছেলের জঙ্গি হওয়ার কথা শুনে বার বার জ্ঞান হারান। টানা তিন দিনের অভিযানে তিনি আরও কাতর হয়ে পড়েন। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে এখন তিনি বেহুঁশ হয়ে রয়েছেন। মাঝেমধ্যে জ্ঞান ফিরলেও তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে বিড়বিড় করে কথা বলছেন। গতকাল সকালেও তিনি ছিলেন অচেতন।

সর্বশেষ খবর