সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

থামছে না শীতলক্ষ্যায় অবৈধ বালু উত্তোলন

হুমকিতে নদী, মহাসড়ক, সেতু, শহর, ৩ কিলোমিটার যেতে ঘুরতে হয় ২৫ কিলোমিটার, ভাঙনের কবলে গ্রামবাসী

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

থামছে না শীতলক্ষ্যায় অবৈধ বালু উত্তোলন

কোনোভাবেই থামছে না শীতলক্ষ্যা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন। সরকারিভাবে কোনো অনুমোদন না থাকলেও শীতলক্ষ্যা ও বানার নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সরকারদলীয় কতিপয় নেতা অবৈধ বালু উত্তোলন করছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। এতে গাজীপুরের কাপাসিয়া, শ্রীপুর, কালিগঞ্জ এলাকার শীতলক্ষ্যা ও বানার নদী, উপজেলা শহর, মহাসড়ক ও নদীর ওপর নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ ফকির মজনু শাহ সেতু চরম হুমকির মুখে পড়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। পাশাপাশি বালু উত্তোলন করে কাপাসিয়া-শ্রীপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশে বালুর বড় বড় গদি করায় হুমকিতে পড়েছে সড়কটি। কাপাসিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে দস্যুনারায়ণপুর বাজার পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার রাস্তা। অথচ এই রাস্তাটুকু পার হতে কোনো যানবাহন রাজিই হয় না। ফলে এই তিন কিলোমিটার পথ যেতে ঘুরতে হয় ২৫ কিলোমিটার। শুধু তা-ই নয়, কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদ-ঘেঁষা সাফাইশ্রী খেয়াঘাট এলাকায় যত্রতত্র বালুর গদি বসানো হয়েছে। এতে চরম হুমকির মুখে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ সড়কসহ উপজেলা পরিষদ-সংলগ্ন এলাকাটি। প্রশাসনের নাকের ডগায় যত্রতত্র এভাবে একক আধিপত্যের সঙ্গে বালুদস্যুদের কর্মকাণ্ড যেন

 কেউ দেখেও না দেখার ভান করে আছে। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বিভিন্ন এলাকায় নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বালু উত্তোলনের কারণে জায়গায় জায়গায় ভূমিধসের ঘটনাও ঘটছে। এবারের বর্ষা মৌসুমে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী মানুষজন। নদীভাঙনে কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালিগঞ্জের লক্ষাধিক নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনে প্রশাসন কোনো ধরনের উদ্যোগই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছেন বালু ব্যবসায়ীরা। অবৈধভাবে অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে একের পর এক ভূমি দেবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দীর্ঘ ১২ বছরের বিভিন্ন সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় এলাকায় বড় ধরনের কয়েকটি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। ভূমিধসগুলো এতই ভয়াবহ ছিল যে ৩০-৩৫ ফুট গভীর অতলে দেবে যায় বসতবাড়ি। শুধু তা-ই নয়, নদীতে গোসল করতে গিয়ে ড্রেজারের নিচে পড়ে দুই ছাত্র ও এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সেই মৃত্যুর ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেন প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা। আর এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কথিত বালুদস্যু শ্রীপুরের হারুনুর রশীদ বাদল ওরফে বাঘ বাদল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ। শুধু তা-ই নয়, কালিগঞ্জের কথিত যুবলীগ নেতা কামরুল, কাপাসিয়ার কৃষক লীগের একাধিক নেতা থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করছে। শুধু আওয়ামী লীগের নেতারাই নন, অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন। তবে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাকছুদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা ও বানার নদীর কাপাসিয়া অংশে রাতের আঁধারে কেউ কেউ বালু উত্তোলন করছে এমন খবর পেয়ে প্রায় সময় অভিযান চালানো হয়। এর পরও আমাদের অগোচরে বালু ব্যবসায়ীরা রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করছে।’ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কাপাসিয়া-শ্রীপুর আঞ্চলিক সড়কের কাপাসিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে দস্যুনারায়ণপুর বাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তাটুকু সম্পূর্ণ চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাত্র তিন কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা। এমনকি এ রাস্তার সমস্যা এড়িয়ে চলতে ২৫ কিলোমিটার ঘুরে রাজাবাড়ী হয়ে শ্রীপুর দিয়ে বা রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে যানবাহন। কাপাসিয়ার দক্ষিণে ধানদিয়া থেকে উত্তরে কুড়িয়াদী পর্যন্ত শীতলক্ষ্যায় বালু লুটের মহোৎসব চলছে। স্থানে স্থানে ড্রেজার দিয়ে নির্বিঘ্নে বালু উত্তোলন করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, শ্রীপুরের বাঘ বাদল নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা ও কাপাসিয়ার কৃষক লীগের একাধিক নেতা লতিফপুর, নারায়ণপুর, বাঘিয়া, তরগাঁও, চাপাতসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন। বালু উত্তোলনের কারণে এসব এলাকা এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দস্যুনারায়ণপুর গ্রামের কলেজছাত্র ইমরান হোসেন বলেন, ‘ভাই, রাস্তা নয়, এটি কাদামাটির খেত। এ রাস্তা দিয়ে হাঁটাই যায় না। দেদারসে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় ভেঙে গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষের জায়গা-জমি ধসে পড়েছে।’ বিশু চন্দ্র নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা বালুর এসব অবৈধ ব্যবসা করছেন দেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তেমন কিছু বলতে সাহস পান না।’ সাফাইশ্রী এলাকায় রয়েছে একটি সরকারি প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে অসহায় প্রতিবন্ধীরা একটু সেবা নিতে এখানে আসেন। কিন্তু বিপাকে পড়েন রাস্তার জন্য। বালুদস্যুদের কবলে পড়ে সাফাইশ্রীর সেবাকেন্দ্রটি এখন অচল অবস্থায় প্রায়। বাসস্ট্যান্ড এলাকার আরমান বলেন, ‘বালুভর্তি ট্রাক-লরি যখন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে, তখন মনে হয় যেন ভূমিকম্প হচ্ছে!’ অন্যদিকে রানীগঞ্জ-ঢাকা সড়কের রায়নন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কয়েকটি বালুর গদি রয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের অবুঝ শিশুরা বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। অবৈধ এ বালুর গদির পাশের তিনতলা বাড়িটি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যেতে চাইছেন বাড়ির মালিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভাই, ব্যবসা টেকাতে প্রতিমাসে থানা পুলিশ ও প্রশাসনকে মাসোহারা দিয়ে আসছি। এর পরও সাংবাদিকরা আমাদের পেছনে লেগে আছেন।’ তিনি দম্ভের সঙ্গে বলেন, ‘থানা পুলিশ ম্যানেজ থাকলে সাংবাদিকরা লিখে কী করতে পারবেন। অনেকেই তো লেখেন। কিন্তু কিছুই তো হয় না।’ বাঘিয়া গ্রামের নিরীহ কৃষক আহমেদ হোসেন জানান, পাড় ভেঙে তার কয়েক শতাংশ জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভয়াবহ ভাঙনের আশঙ্কায় গ্রামবাসী বিভিন্ন সময় কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি। সেখানকার রাস্তা ঘুরে চেনার উপায় নেই যে এটি রাস্তা। এমনই অবস্থা হয়েছে, যখন-তখন এখানে চারা রোপণ করে ধান চাষ করা যাবে। অন্যদিকে বালুর গদির অতিরিক্ত পানিতে আশপাশের বাড়িঘর সাধারণ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউএনওসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। এলাকার ষাটোর্ধ্ব বয়সের আমির আলী বলেন, ‘বালুর পানির কারণে এ এলাকায় এখন বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টাই বাড়িঘরে পানি থাকে। ঘরের ভিতর শিশুদের ২৪ ঘণ্টাই আটকে রাখতে হয়। বালুর গদির পানি বাড়িঘরে আসায় প্রতিবাদ করলে উল্টো বালুদস্যুরা আমাদের ওপর চড়াও হন। আমাদের মারধর করতে উদ্যত হন।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাপাসিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘সারা দিনই আমার বাড়িতে পানি থাকে। ঘরের ভিতরও পানি প্রবেশ করায় কাদার সঙ্গে বাস করতে হয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর