বুধবার, ১০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রেললাইন নয় যেন কাঁচাবাজার

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলসড়ক

আলী রিয়াজ

রেললাইন নয় যেন কাঁচাবাজার

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলসড়ক হয়ে উঠেছে বাজার আর বস্তিবাসীর আবাসন। ১৭ কিলোমিটার পথের উভয় পাশে অবৈধ স্থাপনার জন্য পুরো রেলসড়কটি পরিণত হয়েছে সরু গলিতে। আর এই সরু গলি দিয়েই প্রতিনিয়ত চলছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেল যোগাযোগ। দ্রুত ও সহজে যাতায়াতের জন্য যারা রেলের যাত্রী হন তাদের ভোগান্তি কম হলেও প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে দুর্ঘটনা। সরু গলির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার জন্য বন্ধ হয়ে যায় রেল। আর এর ফল ভোগ করতে হয় যাত্রীদের।

জানা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নারায়ণগঞ্জ ১ নম্বর রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রতিদিন ৯ জোড়া রেল চলাচল করে। সেবার মান ভালো না হলেও প্রায় ৪০ হাজার লোক এ পথে যাতায়াত করেন। যানজট এড়াতে মানুষ ট্রেন যাতায়াত বেছে নিয়েছেন। অথচ এ রেলপথের উভয় পাশ অবৈধ দখলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর টিটিপাড়া থেকে শুরু হয় মূল সড়ক। আর দখলের শুরু এখান থেকেই। টিটিপাড়া রেলগেটের পর গোপীবাগ-সায়েদাবাদ পর্যন্ত দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের দোকান। এর মধ্যে সায়েদাবাদের পূর্ব পাশে বিশাল আকারে মার্কেট তৈরি করা হয়েছে। এ মার্কেটে হোটেল, চায়ের দোকান ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সায়েদাবাদের পর স্বামীবাগ থেকে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত দুই পাশে গড়ে উঠেছে লোহার তৈরি বিভিন্ন উপকরণের কারখানা। কারখানাগুলোর সঙ্গে গবাদিপশুর ফার্মও চলছে রেললাইন ঘেঁষে সড়কের ওপর। দয়াগঞ্জে রেলের জন্য উড়ালসড়ক রয়েছে। উড়ালসড়ক পার হলে গেন্ডারিয়া, ঘুণ্টিঘরের পর দেখা যায় লাইনের উভয় পাশে ছোট ছোট বস্তিঘর। ভাসমান মানুষের খুপরি। এর পরই শুরু হয়েছে বিশাল কাঁচাবাজার। এই কাঁচাবাজার চলে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। এই কাঁচাবাজারের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ কিলোমিটার। সকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মালামাল বিক্রি করা হয় এখানে। পলিথিন টানিয়ে ঘুপচিঘরের মতো ছাউনি দিয়ে পণ্য বিক্রি করেন দোকানদাররা। আবার কেউ কেউ পণ্যের পসরা নিয়ে রেললাইনের ওপর যে যার মতো বসে মালামাল বিক্রি করেন। বাজারের দোকানগুলো লাইনের এত বেশি কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে যে ট্রেন এলে দোকানের ছাউনি গুটিয়ে নিতে হয়। জুরাইন রেলগেটের পর বরইতলা পর্যন্ত দুই পাশে ফার্নিচারের বিশাল মার্কেট গড়ে উঠেছে। অবৈধভাবে দখল করা এ মার্কেটের অনেক দোকানে স্থায়ী ভবনও তৈরি করেছেন অনেকে। বরইতলার পর সড়কের উভয় পাশে দেখা গেল শত শত বস্তিঘর। এসব বস্তিঘরে বসবাসকারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন পার করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসা, রসুলপুর, বউবাজার, পাগলা বাজার রেললাইন, নন্দলালপুর রেলগেট, আলীগঞ্জ, ফতুল্লা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে বস্তিবাসীর বসবাস। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইলের দোকান, চায়ের দোকান, সাইকেল-রিকশার গ্যারেজ। নারায়ণগঞ্জে পৌঁছানোর পর ইসদাইর, ২ নম্বর রেলগেট, ১ নম্বর রেলগেটের প্রায় ৪ কিলোমিটার জুড়ে দখল করে বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে দোকানগুলোয় দিনরাত চলছে ক্রয়-বিক্রয়। ইসদাইর রেলগেটের সামনে গিয়ে দেখা যায়, যখন ট্রেন চলে, সব দোকানদার একই সঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। ‘সরে যান, সরে যান, রেল আসছে’ চিৎকার শুনে সবাই যে যার মতো দোকান গুটিয়ে ফেলেন। এখানে কথা হয় ফলবিক্রেতা আসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, সকালে ঢাকাগামী ট্রেন অনেক সময় দুর্ঘটনা এড়াতে থেমে থেমে চলে। মালামাল কিনতে আসা লোকজন কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকায় ট্রেনের আগমন টের না পাওয়ায় দুর্ঘটনার শিকার হন। দোকানদারদের কাছে বাঁশি আছে। রেল আসার শব্দ পেলে সবাই বাঁশি বাজান। এভাবে সবাইকে সতর্ক করা হয়। এই দোকান কীভাবে নিয়েছেন— জানতে চাইলে ওই দোকানি বলেন, জিআরপি পুলিশ ভাড়া নেয়। থানা পুলিশও নেয়। প্রতিদিন ২০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। তবে দোকান বড় হলে ১০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। প্রতিদিন সকালে এসে ভাড়া নিয়ে যায় তারা। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায়ও আসে ভাড়া নিতে। কোনো রাজনৈতিক নেতা বা এদের কেউ ভাড়া নেয় কি না— জানতে চাইলে বলেন, না, কোনো দলের নেতারা নেন না। শুধু পুলিশই ভাড়া নেয়। জুরাইন এলাকার কাঁচামাল-বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন ১০০ টাকা দিয়ে দোকান বসাই। প্রায় সময় উচ্ছেদের পর দোকান বসাতে বেশি টাকা লাগে।’ নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকা থেকে গলাচিপা রেলগেট এলাকার রেললাইনের উভয় পাশে প্রায় ৩০ বিঘার মতো জমির ওপর তিন শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, দখল হয়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ জমির অবৈধ স্থাপনা থেকে মাসে ১০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়। এখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ভাড়া পরিশোধ করে এ ব্যবসা চালানো হয়। এখানে কোনো ব্যক্তি কিছু দখল করেনি। কর্মকর্তারাই ভাড়া দিয়েছেন। এসব বিষয়ে জানতে স্টেশনমাস্টার মোস্তফা কামালের কাছে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বেলায়েত হোসেন নামে আরেক স্টেশন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো দখল নেই। রেললাইনের পাশে দখল আছে কি না আমি জানি না।’ তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে ঢাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলুন।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, রেলওয়ের অবৈধ দখলে থাকা জমি দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সব ধরনের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে কোনো কর্মকর্তা দখলের সঙ্গে জড়িত নন বলে তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর