বুধবার, ১৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে

জিন্নাতুন নূর

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে

সোমবার রাতে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখীর ঝড়ে বগুড়া শেরপুর উপজেলার শেরপুর-ধুনট সড়কে হুসনাবাদ এলাকায় অটোরিক্সার ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় ৫ জন যাত্রী আহত হন। ছবিটি মঙ্গলবার সকালে তোলা হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে সরকার একে গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কার্যত কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ফলে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলছে। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে এই দুর্যোগে অন্তত ৪০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের বজ্রপাত সংক্রান্ত গবেষণাগুলো বলছে, গ্রামাঞ্চলে খোলা স্থানে ও ঘরের বাইরে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। আর কৃষক ও  ফসলের মাঠে কাজ করা নারী-পুরুষ এবং স্কুল শিক্ষার্থীরা বজ্রপাতে দুর্ঘটনার শিকার  বেশি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এপ্রিল-জুন এ বজ্রপাতের ঘটনা কিছুটা বেশি হলেও মে মাসে এই দুর্যোগ আরও বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাতাস সালফার ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বাইরে উঁচু বৃক্ষ নিধন, মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি ও উঁচু ভবনে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থানও বজ্রপাতের জন্য দায়ী। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক গবেষণা বলছে, বজ্রপাতের সময় যারা ঘরের বাইরে অবস্থান করেন তাদের দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি। এর মধ্যে ৫১ শতাংশই কৃষক দুর্ঘটনার শিকার হন। তারা বজ্রপাতের সময় নিজেদের খেতে কাজ করেন। আর ১১ শতাংশই শিক্ষার্থী খোলা মাঠে খেলার সময় বজ্রপাতে দুর্ঘটনায় পড়েন। তবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যারা এ সময় ঘরের মধ্যে অবস্থান করেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হন। দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো হচ্ছে— চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ,  লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শ্রীমঙ্গল, সিলেট, ফরিদপুর ও সৈয়দপুর। আর ঢাকায় গড়ে প্রতি বছর ১২৪টি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় পরিচালিত গবেষণা থেকে জানা যায়, বজ্রপাত সম্পর্কে এসব এলাকার ৫৮ শতাংশ মানুষই অসচেতন। বজ্রপাত শুধু মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটায় না। এর সঙ্গে ফসল, ঘরবাড়ি ও মৎস্য সম্পদেরও ক্ষতি করে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, বজ্রপাতের জন্য ৭০ শতাংশ মানুষ হালকা, ২০ শতাংশ মধ্যম মানের এবং ১০ শতাংশ মানুষ উচ্চ শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া একই কারণে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ত্বক এবং মস্তিষ্কের সমস্যায় আক্রান্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ূন আখতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার, আবহাওয়ার পরিবর্তন বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। তা ছাড়া গ্রামে অধিকাংশ বাড়ি টিনের তৈরি হওয়ায় বজ্রপাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ইদানীং ভবন নির্মাণের সময় বজ্রপাত-সহায়ক স্থাপনার ব্যবহারও কমে এসেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সাধারণত বর্ষা মৌসুমের সময় বজ্রপাত বেশি হয়। এ হিসেবে মার্চ থেকে জুন মাসে বজ্রপাত হয়। তবে দেশে মে মাসেই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের মাসিক ও বার্ষিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ২০১৩ হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শুধু মে মাসে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ১২৮, ৭৯, ৯১, ১৩২ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১১-১২ মে বজ্রপাতে বাংলাদেশে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়। এ বছর মোট বজ্রপাতে মারা যায় ৩৫০জন। এ অবস্থায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে ঢাকাসহ চিহ্নিত কয়েকটি জায়গার বাড়ির ছাদে বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম এম আমানত উল্লাহ খান এই প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হঠাৎ করে শুধু বাংলাদেশে না পুরো এশিয়ায় কেন এই দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা গবেষণা করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। বজ্রপাতের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞরা মানুষকে পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর আকাশে মেঘের গুড়গুড় ডাক শুনলেই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কোনোভাবেই এ সময় ফাঁকা মাঠে থাকা যাবে না। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকার ও গণমাধ্যমে বজ্রপাতের সময় করণীয় সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। এ ছাড়া এ সময় মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করা ও বজ্রপাতের সময় পানির সংস্পর্শে না থাকার পরামর্শ দেন তারা।

সর্বশেষ খবর