শুক্রবার, ১৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

কৃত্রিম সংকটে অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার

পর্যাপ্ত মজুদ রেখে সক্রিয় সিন্ডিকেট

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর ও ভোজ্যতেলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় প্রতিনিয়তই অস্থিরতা বিরাজ করছে বাজারে। রমজানে এসব পণ্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায় বলে আমদানিও হয় পর্যাপ্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজানকে কেন্দ্র করে গত ছয় বছরে এবারই সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। তবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৪২ ব্যবসায়ীর গুদাম পূর্ণ ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর ও ভোজ্যতেলে। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর কজন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সিন্ডিকেট পণ্য আমদানি করে গুদামজাত করে রেখেছে। ফলে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তাসাধারণ।

ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাইকারি ও খুচরা বাজারে ছোলা এবং চিনি বিক্রির সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভালো মানের প্রতি কেজি ছোলা ৮০ এবং মাঝারি মানের ছোলা ৭৫ টাকায় পাইকারি বিক্রি হবে। আর খুচরা মূল্য হবে ৮৫ ও ৮০ টাকা। একইভাবে প্রতি কেজি চিনি পাইকারি ৫৮ থেকে ৬০ এবং খুচরায় ৬২ থেকে ৬৩ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের বাজারে নির্ধারিত এ দামের চেয়ে প্রতিটি পণ্য কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ছোলার অন্যতম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘দাম নির্ধারণের বিষয়টি পাইকারিতে মানা হলেও খুচরা বাজারে নিয়ন্ত্রণ নেই কারোর। ফলে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানির পরও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালের মতো বিভাগীয় শহরে দাম নির্ধারণ করে না দিয়ে শুধু চট্টগ্রামে নির্ধারণের বিষয়টি অযৌক্তিক।’ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর কজন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করছেন রমজানে বাজার অস্থির করতে।

ছোলার মজুদ ৯ প্রতিষ্ঠানের হাতে : রমজানের জন্য ছোলা মজুদ করেছেন নয়টি প্রতিষ্ঠান। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭৪ জন ব্যবসায়ী ৯৫০ কোটি টাকা মূল্যের দুই লাখ ১৫ হাজার টন ছোলা আমদানি করেন। ৬০ শতাংশ এনেছেন নয়জন ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সর্বাধিক ৫৭ হাজার টন ছোলা এনেছে আবুল খায়ের গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। ২৮ হাজার টন ছোলা এনেছে সিলভার ডাল অ্যান্ড মিলস লিমিটেড। মেসার্স এনআর ট্রেডিং ২৪ হাজার টন, রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ১৬ হাজার ৩৪৫ টন, গাজী ট্রেডিং সাড়ে ৯ হাজার টন, ফ্লেটচার ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোর্ট লিমিটেড ৮ হাজার ৮০০ টন, লাকী ট্রেডিং প্রায় ৮ হাজার টন, ইসলাম ব্রাদার্স ২ হাজার ৭০০ টন ও রিলায়েন্স করপোরেশন ২ হাজার ৪০০ টন ছোলা আমদানি করেছে। গত বছরের একই সময়ে দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৬৫ হাজার টন।

চিনির বাজার ৫ ব্যবসায়ীর হাতে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি চিনিকলগুলো প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার টন চিনি সরবরাহ করে। প্রতিমাসে প্রায় এক লাখ টন চিনির চাহিদা থাকলেও রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চিনির বাজারে কারসাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এদিকে প্রতিবারের মতো কয়েকজন মিলমালিক সংস্কারের নামে রমজানকে কেন্দ্র করে পণ্যের সংকট তৈরি করতে উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১১ লাখ ২৬ হাজার টন চিনি আমদানি হলেও এবার একই সময়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ৪ লাখ টন বেশি চিনির কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। দেখা গেছে, এবার পাঁচজন ব্যবসায়ী এই চিনি আমদানি করে নিয়ন্ত্রণ করছেন বাজার। আমদানি চিনির ৩৫ শতাংশ এনেছে মেঘনা গ্রুপ। ৩১ শতাংশ এনেছে সিটি গ্রুপ। এস আলম গ্রুপ ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, আবদুল মোনেম গ্রুপ ১০ শতাংশ ও দেশবন্ধু গ্রুপ এনেছে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এ হিসাবে মোট আমদানি করা চিনির ৯৪ দশমিক ৬২ শতাংশ এনেছে এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান। খাতুনগঞ্জের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স জিএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মুসলিম উদ্দিন বলেন, চিনির বাজার নিয়ে কারসাজির সুযোগ নেই। মূলত রমজান ও গরমের কারণে পণ্যটির চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু মিল থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও বাজারে সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি মীর আহম্মদ সরদারের স্বত্বাধিকারী আবদুচ সালামের কাছ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিনিকল মালিক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, পাইকারি বাজারে দাম বাড়লেও মিল গেটে চিনির দাম বাড়েনি। মিল গেট থেকে প্রতি মণ চিনি ২২৬০-২২৬৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মূলত পাইকারি ব্যবসায়ীরাই বাজারে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছেন। এদিকে পাইকারি বাজারের প্রভাবে গত কয়েক দিনে খুচরায় পণ্যটির দাম পাঁচ থেকে সাত টাকা বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৫৭-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম ঠেকেছে ৬৫ টাকায়। সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিত সাহা বলেন, রমজানে চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। এতে মিলমালিকরা চিনির সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন।

ভোজ্য তেল নিয়ন্ত্রণে ৮ প্রতিষ্ঠান : চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪২০ টন ক্রুড সয়াবিন আমদানি হয়েছে। আর রিফাইন্ড পাম অয়েল আমদানি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন। আমদানি করা এই ভোজ্য তেল মজুদ রয়েছে আটটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে তানভির অয়েলস লিমিটেড এক লাখ ১৬ টন, বাংলাদেশ এডিবয়েল এক লাখ তিন হাজার টন, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ৯৯ হাজার টন, দীপা ফুড প্রোডাক্ট ৮৫ হাজার টন, সুপার অয়েল রিফাইনারি ৬০ হাজার টন, এস আলম সুপার এডিব অয়েল ৩৭ হাজার টন, ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারি ৩৬ হাজার টন ক্রুড সয়াবিন আমদানি করেছে।

সর্বশেষ খবর