রবিবার, ২১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাবনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিপর্যস্ত

ভূমিমন্ত্রীর পুত্র-জামাইর আধিপত্যের দ্বন্দ্ব

এস এ আসাদ, পাবনা

আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত পাবনার ঈশ্বরদীতে শুধু ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর পুত্র ও জামাতার মধ্যকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। অন্যদিকে ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে সৃষ্ট নৈরাজ্যে ঈশ্বরদীতে দলীয় নেতা-কর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। তবে এ বিরোধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের নয়, বিরোধ মূলত জামাই-শ্বশুরে। প্রায় প্রতিদিনই এ দুটি গ্রুপের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদে ঈশ্বরদী আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে। মূলত ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে ঈশ্বরদীর পরিবেশ এখন অস্থিতিশীল। ঘটছে হামলা-ভাঙচুর, চাঁদাবাজিসহ হত্যার মতো ঘটনা। জামাই, না শ্বশুর— কে বেশি ক্ষমতাধর এলাকায় এর প্রদর্শন চলছে। উভয় পক্ষই প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, হামলা-ভাঙচুরসহ নানাভাবে পেশিশক্তির ব্যবহার করছে। আধিপত্য বিস্তারের কারণ হিসেবে আগামী সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া উপজেলা) আসন থেকে দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়েই মূলত জামাই-শ্বশুরের দ্বন্দ্ব শুরু। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর জামাতা ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কামাল আজাদ মিন্টু চান শ্বশুরের স্থলাভিষিক্ত হতে। অন্যদিকে মিন্টুর স্ত্রী ভূমিমন্ত্রীর মেয়ে মেহজাবিন শিরিন পিয়াও নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার পক্ষে রয়েছেন স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ, মেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহজাবিন শিরিন পিয়া, ছেলে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকার, ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মিন্টু, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মন্ত্রীর এপিএস বশির আহমেদ বকুল। অন্যদিকে জামাই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কামাল আজাদ মিন্টুর পক্ষে রয়েছেন ঈশ্বরদী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস, শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা রশিদুল্লাহ, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাস, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাম খানসহ স্থানীয় ঠিকাদারদের বড় একটি অংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলীয় একাধিক নেতা-কর্মী জানান, একসময় ঈশ্বরদীতে একক আধিপত্য ছিল মন্ত্রীর জামাতা মিন্টুর। তার কথায় সবকিছু হতো। ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে মিন্টুর নানা নির্দেশ পালন করতেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম খান ও ছাত্রলীগ সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাস। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায়, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমানের কথাও ওই তিনজন অমান্য করতে শুরু করেন। এরই মধ্যে গেল বছরের ২৫ জুন যুবায়েরের গুলিতে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন এ ছাত্রলীগ নেতা আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। এরপর মিন্টুর নির্দেশে আরও একটি আলোচিত ঘটনার জন্ম দেন সালাম খান ও যুবায়ের। তাদের নেতৃত্বে গেল বছরের ১০ আগস্ট ঈশ্বরদীতে মন্ত্রী-সমর্থকদের জঙ্গিবিরোধী মিছিলে গুলি ও হামলা চালানো হয়। ওই সময় থেকেই মূলত জামাই-শ্বশুরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। সালাম খান ও যুবায়ের বিশ্বাসকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন মন্ত্রী। এর পরই মিন্টু কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এতে তাদের পদ্মা নদীর বালুমহাল, মাদক স্পটের চাঁদা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজসহ বিভিন্ন দফতরের ঠিকাদারি হাতছাড়া হয়ে যায়। অন্যদিকে ঠিকাদারি, মাদক স্পটের চাঁদা ও কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মন্ত্রী বিকেএসপিতে অধ্যয়নরত ছেলে শিরহান শরীফ তমালকে ঈশ্বরদী নিয়ে আসেন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তমাল সপ্তম। গেল বছরের ১৯ নভেম্বর বাবার দৌলতে উপজেলা যুবলীগের সভাপতির পদ পান তিনি। একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক করা হয় রাজীব সরকারকে। পদ পাওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তমাল। রাজীব সরকারের সার্বক্ষণিক পরামর্শে উপজেলার সব প্রতিষ্ঠানে তিনি হস্তক্ষেপ শুরু করেন। দীর্ঘদিন নীরব থাকা মন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ ছেলে তমাল ও ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মিন্টুকে দিয়ে এলাকায় আবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। ভূমিমন্ত্রী তার আধিপত্য ধরে রাখতেই তমালকে রাজনীতির মাঠে নামিয়েছেন। জামাই, না শ্বশুর— কে বেশি ক্ষমতাধর এলাকায় এর প্রদর্শন চলছে। উভয় পক্ষই হামলা-ভাঙচুর, প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন ও নানাভাবে পেশিশক্তির ব্যবহার করছে। ইতিমধ্যে তমাল গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে অসহায় দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ; ভয়-আতঙ্ক নিত্যসঙ্গী ঈশ্বরদীবাসীর। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ভূমিমন্ত্রীর ছেলের ‘ইশারা’ ছাড়া ঈশ্বরদীতে কোনো কাজই হয় না। দখল-আধিপত্য-চাঁদাবাজিতে এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে নৈরাজ্য। আর জামাই-শ্বশুরের কোন্দলে ঈশ্বরদীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। পাবনা জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মন্ত্রীর ঠাণ্ডা বিরোধ তৈরি হয়। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল রহিম লালের বিপরীতে প্রার্থী হন মন্ত্রীর মেয়ে মেহজাবিন শিরিন পিয়া। ওই সময় জেলা আওয়ামী লীগের একটি দল ঢাকায় মন্ত্রীর বাসায় দেখা করে তার মেয়েকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানায়। তবে মন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিনিধিদলকে বলেছিলেন,  ‘যেহেতু এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তাই যে-কেউ প্রার্থী হতে পারেন। আমি কাউকে নিষেধ করতে পারব না।’ নির্বাচনে মন্ত্রীর মেয়ের ভরাডুবি ঘটে। ভূমিমন্ত্রী ডিলুর মেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহজাবিন শিরিন পিয়া বলেন, ‘আমরা চাইব আমার বাবা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাক। বয়সের কারণে তিনি যদি মনোনয়ন না পান তবে আমি মনোনয়ন চাইব।’ এদিকে পৌর মেয়রের সমর্থকরা বলেন, মিন্টু দীর্ঘদিন তৃণমূলের রাজনীতি করছেন। তিনি মন্ত্রীর জামাই। তাই ভবিষ্যতে মিন্টুই মন্ত্রীর উত্তরাধিকারী। এ ব্যাপারে পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময় অন্যায়কারীদের স্থান নেই। ঈশ্বরদীতে অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’ বৃহস্পতিবারের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত যুবায়ের বিশ্বাস বলেন, ঈশ্বরদীতে তমাল ও রাজীব সরকারের নেতৃত্বে নানা অপকর্ম হচ্ছে। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ কোনো কথা বলতে পারেন না। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মোবাইলে ফোন করা হলে তার ছেলে তাকিবুর রহমান শরীফ তা রিসিভ করে বলেন, ‘বাবা অসুস্থ। বিশ্রামে আছেন। পরে কথা বলবেন।’ পরে একাধিকবার ফোন করেও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল বলেন,  সভাপতি নিজের এলাকায় দলের স্বার্থ না দেখে নিজের পরিবারের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কে নেতৃত্বে আসবে, পরিবারে নেতৃত্ব থাকবে কি না এ সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো রাজনৈতিক নেতার কাজ নয়। ঈশ্বরদীর বর্তমান অবস্থায় দলের চরম ক্ষতি হচ্ছে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দিনের আলোয় মুখে কালো কাপড় বেঁধে ভূমিমন্ত্রীর জামাতা ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কামাল আজাদ মিন্টুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। হামলায় নেতৃত্ব দেন ভূমিমন্ত্রীর ছেলে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকার। একই সময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের  দোকানে হামলার পাশাপাশি মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাসের বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। রাতেই মামলা করেন যুবায়েরের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার বিশ্বাস। কিছু সময় পর মন্ত্রীর বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ। শুক্রবার ভোরের দিকে ভূমিমন্ত্রীর ‘ক্ষমতাধর’ ছেলেসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১১ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান।

সর্বশেষ খবর