মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আটকে পড়া সবজি ফল মাছ পচে যাচ্ছে, বিক্ষুব্ধ চাষিরা

উত্তরাঞ্চলে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত

প্রতিদিন ডেস্ক

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় ১৬ জেলায় ট্রাক-ট্যাংকলরি-কাভার্ড ভ্যান-পিকআপ চলাচল বন্ধ থাকায় বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া মাছ, ফল, সবজিসহ পচনশীল পণ্যসামগ্রী পচে যেতে শুরু করেছে। সরবরাহকারীরা এগুলো নির্ধারিত গন্তব্যে পাঠাতে পারছেন না। এ অবস্থায় বেশ কিছু স্থানে চাষিরা তাদের পণ্য রাস্তায় ফেলে ধর্মঘটের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন। অন্যদিকে ধর্মঘটীরা তাদের কর্মসূচি আরও একদিন বাড়িয়েছেন। প্রসঙ্গত, সড়ক ও মহাসড়কের যেখানে-সেখানে যানবাহন থামিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ, নতুন খসড়া আইন প্রত্যাহার, বিভিন্ন স্থানে ওয়ে স্কেলের নামে চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ, অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করাসহ ৭ দফা দাবিতে গত রবিবার থেকে উত্তরবঙ্গ ট্রাক-ট্যাংকলরি-কাভার্ড ভ্যান-পিকআপ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে এ কর্মবিরতি (ধর্মঘট) পালন করা হচ্ছে। এ কর্মসূচি আজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দাবি বাস্তবায়নে উদ্যোগ না নেওয়ায় চলমান পণ্য পরিবহন ধর্মঘটের মেয়াদ আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে ২৪ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে বগুড়া প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মান্নান আকন্দ এ ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এরপরও যদি দাবি মানা না হয় তাহলে রমজান মাসের পর লাগাতার কর্মবিরতি পালন করা হবে। রংপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, টানা ধর্মঘটের কারণে হাজার হাজার মণ কাঁচা সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রংপুরের চাষিরা। বাইরের জেলায় সবজি পাঠাতে না পারায় স্তূপ করে রাখা সবজিতে পচন ধরেছে। এ অবস্থায় সবজির বাজারেও ধস নেমেছে। জেলার মিঠাপুকুর, পীরগাছা, তারাগঞ্জ ও সদর উপজেলা থেকে প্রতিদিন ২০০-৩০০ ট্রাক বেগুন, পটোল, করলা, বরবটি, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, শসা, ঝিঙ্গা, চালকুমড়া ও কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন শাকসবজি রাজধানীসহ দেশের অন্য জেলায় রপ্তানি হয়। এর মধ্যে মিঠাপুকুর থেকেই প্রতিদিন ১০০-১৫০ ট্রাক সবজি বাইরের জেলায় যায়। ধর্মঘটের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। পাইকারি ক্রেতা না আসায় প্রতিটি সবজির দাম গড়ে কেজি প্রতি ৫-২০ টাকা কমে গেছে। বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, পণ্য পরিবহনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় উত্তরবঙ্গ থেকে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। কেউ অন্য কোনোভাবে পণ্য পরিহনের চেষ্টা করলে সড়ক ও মহাসড়কে মালিক ও শ্রমিকরা তাতে বাধা দিচ্ছেন। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটের ফাঁদে পড়ে বগুড়ার সবজির হাটে ক্রেতা নেই। যেখানে দিনে ৮০ থেকে ৯০টি ট্রাক কাঁচা সবজি লোড দিয়ে ঢাকায় যায়, সেখানে দুই দিনে একটি ট্রাকও সবজি নিয়ে ঢাকায় যায়নি। সবজির হাটগুলোতে চাষিদের সবজি নিয়ে আসতে দেখা গেলেও ক্রেতা নেই। ফলে কৃষকের উৎপাদিত সবজি দাম মণপ্রতি ২০০ টাকা করে কমে গেছে। এ চিত্র মিলেছে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সবজি বাজার মহাস্থানহাট, নয়মাইল, আড়িয়া, শেরপুরসহ অন্যান্য পাইকারি কাঁচাবাজারে। মহাস্থানহাটের ইজারাদার আলহাজ আজমল হোসেন বলেন, সবজির বাজারে আমদানি হলেও পাইকাররা কিনছেন না। কিছু কিছু কিনলেও দাম কম বলছেন। ক্ষতিগ্রস্ত শুধু কৃষকই হচ্ছে না, হাট ইজারা নিয়ে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কর্মবিরতি যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সবজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। দামও বৃদ্ধি পাবে। বাজারে কাঁচামাল বিক্রি করতে আসা কৃষক আবদুস সামাদ, করিম মণ্ডল, আছের আলী বলেন, দুই দিন আগে ঝিঙ্গা বিক্রি করেছি ২০ টাকা কেজি দরে। সোমবার সেই ঝিঙ্গা বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা কেজিতে। মহাস্থান এলাকার সাইদুর রহমান সাজু জানান, সাড়ে ৫০০ টাকার আলু এখন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩০০ টাকায়। ৮০০ টাকার করলা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়, ৮০০ টাকার কাঁচামরিচ দাম কমে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাবনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ধর্মঘটের প্রতিবাদে কৃষকরা মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ও উৎপাদিত কৃষিপণ্য রাস্তায় ফেলে বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল দুপুরে জেলার উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের গেটওয়েখ্যাত পাবনা-রাজশাহী মহাসড়কের মুলাডুলিতে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। জানা গেছে, কয়েকশ কৃষক রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। শেষে তারা তাদের জমিতে উৎপাদিত ঢেঁড়স, লাউসহ বিভিন্ন পণ্য রাস্তায় ঢেলে বিক্ষোভ করেন। তারা জানান, ধর্মঘটের কারণে আড়তদাররা কৃষিপণ্য ক্রয় না করায় ব্যাপক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। তারা অবিলম্বে এই ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি করেন।  সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জ জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক গ্রুপের সভাপতি ও উত্তরবঙ্গ ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ড ভ্যান মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব নূর কায়েম সবুজ জানিয়েছেন, ৭ দফা দাবিতে সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডাকা ধর্মঘট ২৩ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুরাহার প্রস্তাব না আসায় ২৪ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত এ কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী কাঁচামাল ব্যবসার বড় হাট হওয়ায় এখানে বাইরের জেলার ব্যবসায়ীদের ক্রয়কৃত মালামাল পরিবহন করতে না পারায় তারা এখন ক্ষতির হিসাব গুনছেন। অন্যান্য জেলা থেকে পরিবহনে বিভিন্ন মাছ এ জেলায় আসে, বর্তমান সেটি বন্ধ থাকায় মাছের বাজার এখানে চড়া যাচ্ছে। জানা গেছে, অনেক জায়গায় ট্রাকে আটকে থাকা মাছসহ পচনশীল পণ্য পচে যাওয়া শুরু করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটের ফলে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে পিয়াজ ভর্তি ট্রাকসহ প্রায় সাড়ে ৪০০ পণ্যভর্তি ট্রাক আটকা পড়েছে। গত রবিবার স্থলবন্দরে পানামা ইয়ার্ডের ভিতরে ৫০টি পিয়াজ ভর্তি ভারতীয় ট্রাক আটকা পড়ে বলে পানামার টিপু সুলতান নামে এক কর্মকর্তা জানান। তিনি আরও জানান, গতকাল বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত পিয়াজ বোঝাই আরও ১০০ ভারতীয় ট্রাক পানামা ইয়ার্ডের ভিতরে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪০০ পণ্যভর্তি ট্রাক আটকা পড়েছে। পিয়াজ আমদানিকারক নূর মোহাম্মদ জানান, একদিকে ট্রাক ধর্মঘট, অন্যদিকে প্রচণ্ড দাবদাহের ফলে পানামা ইয়ার্ডের ভিতরে আটকে পড়া পিয়াজের ৫০ ভাগই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একইভাবে পাথর ব্যবসায়ীরা জানান, ট্রাক ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন প্রকল্পগুলোতে তারা পাথর সরবরাহ করতে পারছেন না। লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে গতকাল লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে ফল ও পিয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী তিন শতাধিক ট্রাক আটকা পড়ে আছে। এভাবে কয়েক কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হতে বসেছে।

এদিকে রবিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘটের কারণে বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য কোনো দেশি ট্রাক পাওয়া যায়নি। বন্দরগামী প্রধান সড়কের পাশে অনেক পণ্যবাহী ট্রাককে আটকে থাকতে দেখা গেছে। বুড়িমারী স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুহুল আমিন বাবুল জানান, পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে যাচ্ছে। এমন সময়ে এ ধরনের কর্মসূচি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। ধর্মঘটের কারণে ট্রাক না পাওয়ায় আমরা আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছি। আটকা পড়া ট্রাকে নানা রকম ফল ও পিয়াজসহ অন্যান্য পচনশীল পণ্য রয়েছে। এগুলো নষ্ট হলে আমদানিকারকরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তার আশঙ্কা ধর্মঘট দীর্ঘ মেয়াদি হলে কয়েক কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হবে। দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে স্থবির হয়ে পড়েছে হিলি স্থলবন্দরের কার্যক্রম। বন্দরের অভ্যন্তরে পিয়াজ, চালসহ শত শত পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ হারুন বলেন, ‘পরিবহন মালিক শ্রমিকদের কর্মবিরতি চলার কারণে পণ্য পরিবহনে কোনো ট্রাক পাচ্ছি না। ফলে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছি। দেশের কোথাও এসব পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। এতে করে বন্দরের ভিতরে বেশ পরিমাণ পিয়াজসহ অন্যান্য পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়ে আছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে আটকে পড়া এসব পিয়াজে পচন ধরতে পারে। এতে করে এসব পণ্য নষ্ট হলে আমদানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি দ্রুত বিষয়টির সমাধান করা হোক।’

সর্বশেষ খবর