রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্যাট আইন নিয়ে অস্বস্তি সরকারে

অর্থমন্ত্রী বললেন, ১৫ শতাংশই হবে হ সিপিডি চায় ১২

মানিক মুনতাসির

ভ্যাট আইন নিয়ে অস্বস্তি সরকারে

আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ঘনিয়ে এলেও ভ্যাট আইন নিয়ে সৃষ্ট উত্তাপ এখনো কমেনি। বাজেট প্রণয়নের শেষ মুহূর্তের ঘষামাজাতেও রয়েছে নতুন এই ভ্যাট আইনের অস্বস্তি। প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। যে বৈঠকে সাধারণত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, বিভিন্ন পণ্যে করারোপ, কর অব্যাহতি, করপোরেট কর, করমুক্ত আয়সীমা, সঞ্চয়পত্রের সুদহার, কালো টাকা সাদা করার বিষয়সহ খুটিনাটি কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অথচ এ বছর শুধু নতুন ভ্যাট আইন-২০১২ এ ভ্যাট হার নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য একাধিক বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি। অস্বস্তিও কাটেনি। অস্বস্তি শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থবিভাগ আর ব্যবসায়ীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের অভ্যন্তরেও। এমনকি সরকারপন্থি ব্যবসায়ীরাও এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তবে শেষ মুহূর্তে এসে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাটের হার কিছু কমানো হবে। তিনি আরও বলেছেন, এ আইনে ভ্যাটের হার হবে একটাই। কিন্তু ভ্যাটের হার কত হবে সেটা এখনো নির্ধারণ করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে গতকাল বিকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশই হবে। গত কয়েকদিনে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এর সুরাহা হয়নি বলে জানা গেছে। অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার ছুটির দিনে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে বাজেটের শেষ প্রস্তুতি হিসেবে তার সঙ্গে টানা বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে ভ্যাট আইন-২০১২-এর বিষয়ে তিনি অর্থমন্ত্রীকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। ভ্যাটের হার শেষ পর্যন্ত ১২ শতাংশ হতে পারে। তবে ভ্যাটের বাড়তি চাপ থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে ভ্যাটমুক্ত পণ্যের তালিকা লম্বা করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যেসব পণ্যে বলবৎ রয়েছে সেসব পণ্যের পূর্বের ভ্যাট হার বহাল রেখে অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা— সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বাজেট এবং নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে যেন জনগণ ভোগান্তিতে না পড়ে সেদিকে সবার আগে নজর দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ কষ্টের মুখে না পড়ে এ জন্য ব্যবসায়ীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে ভ্যাটের হার নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরের সূত্র জানায়, ১৫ এর পরিবর্তে ১২ শতাংশের একক ভ্যাট হারই কার্যকর করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে উৎপাদন ও সেবা খাতে যেসব ব্যবসায়ী রেয়াত নেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না তাদের জন্য থাকছে বিশেষ হ্রাসকৃত হার। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকে ভ্যাট অব্যাহতির বিদ্যমান সীমা ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। এ জন্য আইনের ধারা ২-এর দফা (৪৮) সংশোধন করা হচ্ছে। একইভাবে টার্নওভারের বিদ্যমান সীমা প্রায় ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। জাতীয় নির্বচানের আগে ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে করমুক্ত টার্নওভার ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এ জন্য নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ধারা ২-এর দফা (৫৭) সংশোধন করার প্রস্তাব করা হতে পারে। সূত্র জানায়, আগামী বাজেট হতে পারে ৪ লাখ ২০০ কোটি টাকার। যদিও অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন নতুন বাজেট হবে ৪ লাখ ৮০০ হাজার কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন বছরের বাজেটের আকার এবারের তুলনায় ৫৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা বেশি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথ নকশাও থাকতে পারে এই বাজেটে। নতুন অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির চাপকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, এসডিজি অর্জনের পথ সুগম করতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে যাচ্ছেন। এ জন্য পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রসহ সরকারের নেওয়া ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে পৃথক ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে চান অর্থমন্ত্রী। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের মাধ্যমে একদিকে বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে চান মুহিত। অন্যদিকে করদাতার সংখ্যা গুনিতক হারে বাড়াতে চান তিনি। নতুন অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। আসছে বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর ব্যবস্থা থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এতে করে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে বিশাল পরিমাণ এই রাজস্ব আদায় করা খুব একটা কঠিন হবে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।

‘মেডিটেশন সেবায় ভ্যাট বসছে না’ : অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, মেডিটেশন সেবা বা ধ্যানচর্চার ওপর ভ্যাট বসছে না। এ থেকে খুব সামান্যই ভ্যাট পাওয়া যায়। এটা আগের মতোই থাকবে। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের বাজেট বক্তৃতায় প্রথম মেডিটেশন সেবাকে ভ্যাটের আওতামুক্ত করার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।

 ওই বক্তৃতায় তিনি বলেন, মেডিটেশন সেবা গ্রহণ করে হতাশাগ্রস্ত অনেক মানসিক ও শারীরিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ মুক্তির প্রয়াস পায়। সে জন্য এ সেবার উপর প্রযোজ্য কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি। গত বাজেটে ভ্যাট আরোপ করা হলেও পরে সেটি প্রত্যাহার করা হয়।

সর্বশেষ খবর