মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পঙ্গুত্বের শিকার পঙ্গু হাসপাতাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

পঙ্গুত্বের শিকার পঙ্গু হাসপাতাল

ময়লা-আবর্জনা, মশা, যত্রতত্র ছড়ানো ব্যবহূত তুলা-ব্যান্ডেজ, দালালের গলাবাজি আর রোগীদের সীমাহীন ভোগান্তির জায়গায় পরিণত হয়েছে জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। হাসপাতালের ভিতরে ওয়ার্ডগুলোর জানালা দিয়ে তাকালে কার্নিশে চোখে পড়ে ফলের খোসা, ঠোঙ্গা, খালি বোতল। ওয়ার্ডের ভিতরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে বিড়াল আর গেটের বাইরে পড়ে থাকা খাবার নিয়ে মারামারি করছে একদল কুকুর। রোগীদের বাগিয়ে হাসপাতালের পাশের ক্লিনিকে ভর্তি করাতে তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন দালালরা। গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে এসব চিত্র। এই হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫৬০। বহির্বিভাগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৫০০ মানুষ আসেন চিকিৎসা নিতে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা গড়ে ১৫০ জন। প্রতিদিন এর প্রায় অর্ধেকই ভর্তি হন। আর এর সঙ্গে ফলোআপে আসা রোগী তো আছেনই। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন নাসির আলী (৫৫)। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ হলো হাসপাতালে রয়েছেন নূরজাহান বেগম। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখানে টাকা না দিলে কিছুই হয় না। ভর্তির সময় বলা হলো বেড ফাঁকা নেই। পরে দালালকে কিছু টাকা দিলে তিনি একটা বেডের ব্যবস্থা করে দেন। ডাক্তার আর নার্স-আয়াদের খারাপ ব্যবহারে চোখে পানি চলে আসে। জরুরি বিভাগের পাশে জমে থাকা ময়লার স্তূপ গত কয়েক দিন আগে সরিয়ে কিছুটা পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। কিন্তু অন্য পাশে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্ডবয় আছেন ৫২ জন (পদ ৭১), আয়া নয়জন (পদ ১৩) এবং সুইপার ৫৬ জন (পদ ৭১)। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল গণি মোল্লা বলেন, আমার ৫৭ কর্মদিবসে ৩০ বছরের জমে থাকা ময়লা অনেকটা পরিষ্কার করে ফেলেছি। হাসপাতালে এই জনবল দিয়ে ঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন করা যায় না। বেশ কিছু কর্মচারী নিয়োগ হওয়ার কথা থাকলেও তা আটকে আছে। মাস্টাররোলে লোক নিয়ে কাজ করাতে হয়। রোগীদের প্রতারণা থেকে বাঁচাতে আমরা সচেতন করার চেষ্টা করি কিন্তু প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার লোকের যাতায়াতে সবকিছু ম্যানেজ করা সমস্যা। হাসপাতালে নার্সদের দুর্ব্যবহারে রোগীদের অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। কোনো কাজই বখশিশ ছাড়া হয় না বলে অভিযোগ করে ফরিদপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা খবির হোসেন বলেন, ‘কোনো কিছুর দরকার পড়লে যদি ওয়ার্ডবয়দের বলা যায় তখন তাদের বখশিশ দিতে হয়। কিন্তু সবকিছুতে এভাবে টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য তো আমাদের নেই। আমরা অসহায় গরিব মানুষ। ডাক্তারদের সমস্যার কথা বলা গেলেও ওয়ার্ডবয়-নার্সদের কিছুই বলা যায় না।’ গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডের কোনো ইউনিটেই ঠিকমতো কাজ হয় না। তাই সংকটাপন্ন রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে আইসিইউ সাপোর্ট করছে না অজুহাত দিয়ে ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে দেন হাসপাতালের কর্মচারীরা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালের কর্মচারীদের যোগসাজশে রোগী বাগিয়ে নেন দালালরা। পঙ্গু হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্যাথলজি এবং ক্লিনিক। পুরুষদের পাশাপাশি বেশ কিছু নারীও কাজ করেন দালাল হিসেবে। শিশু হাসপাতালের সঙ্গে লাগানো পঙ্গু হাসপাতালের পেছন দিকে দেখা যায় ময়লার স্তূপ জমে আছে। সেখানে পুরনো বাক্স থেকে শুরু করে স্যালাইনের বোতলও আছে। এর মধ্যে পানি জমে ডিম ছাড়ছে মশা। এত সমস্যা! কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই।

সর্বশেষ খবর