বুধবার, ৭ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে নন ইউরিয়া সার আমদানি

নিজামুল হক বিপুল

বেসরকারি পর্যায়ে নন-ইউরিয়া সার আমদানিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রতিবছর এই সার আমদানি করে থাকে। চলতি ২০১৭-২০১৮  অর্থ বছরেও চার প্রকারের ১২ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন নন-ইউরিয়া সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যাতে ইতিমধ্যেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জন্য সরকার বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুই লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি, চার লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি, তিন লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি এবং তিন লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন পাউডার এমএপি সার ক্রয় করবে। নন-ইউরিয়া এই সার আমদানির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় গত ১৫ মে দরপত্র আহ্বান করে। ৩১ মে ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের প্যাডে সার সংগ্রহের প্রস্তাব করতে আহ্বান জানানো হয়। আর এই দরপত্রটি আহ্বান করা হয় ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারির সরকারি পরিপত্র অনুসারে।

অভিযোগ উঠেছে, এই দরপত্র নিয়েই যত অনিয়ম হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে এ অনিয়ম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরাবরের মতো একই ব্যক্তি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে সার আমদানির দরপত্রে অংশ নিয়েছে। যা সরকারি নিয়ম বহির্ভূত। জানা গেছে, টিএসপি সার আমদানিতে যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে সেগুলোর মধ্যে ফাইজুর রহমান বকুল নামে এক ব্যক্তিরই ছয়টি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদন রয়েছে। তার আবেদিত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে নওয়াপাড়া ট্রেপিং, দীপা এন্টারপ্রাইজ, সুফলা ট্রেডিং করপোরেশন, আরএস অ্যান্ড টি ইন্টা. এবং নোয়াপাড়া ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। সাইফুদ্দিন মাহমুদ করেছেন রূপালী ট্রেডিং এজেন্সি ও জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজের নামে। নাইম হোসেন (মোশাররফ) মিলেনিয়াম এন্টারপ্রাইজ এবং নাজনীন হোসেন (মোশাররফ) করেছেন নাজনীন এন্টারপ্রাইজ নামে। তারা দুজনেই একই পরিবারের সদস্য। রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি করেছেন তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এগুলো হচ্ছে রাইম ট্রেডিং, মেসার্স রবিউল ইসলাম এবং বিতরণী ট্রেডার্স। এরমধ্যে বিতরণী ট্রেডার্সের দরপত্রটি বাতিল হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন এমওপি সার আমদানির ক্ষেত্রে ফাইজুর রহমান বকুল এখানেও পাঁচটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র আবেদন করেছেন। যদিও এমওপি আমদানিতে তার দীপা এন্টারপ্রাইজের নামে দরপত্র বাতিল বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে এমওপি আমদানির ক্ষেত্রে তিনি দীপা এন্টারপ্রাইজের নামে কোনো দরপত্র জমা দেননি। সাইদুর রহমান বকুলও দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে আবেদন করেন। এগুলো হচ্ছে সাইফুল্লাহ গালফ ও তাইবা সাইফুল্লাহ এসএ। আমিনুর রশিদ খান মামুন করেছেন মিলেনিয়াম এন্টারপ্রাইজ ও দেশ ট্রেডিংয়ের নামে। রবিউল ইসলাম পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে, হাফিজুর রহমান দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে, মোশাররফ হোসেন দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এমওপি আমদানির আবেদন করেন। তাদের এসব আবেদন বাতিল করা হয়। একইভাবে ডিএপি সার আমদানির ক্ষেত্রে রবিউল ইসলাম একাই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে আবেদন করেন। তার প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মো. রবিউল ইসলাম, আর আর ট্রেডিং, রহমান ট্রেডার্স, রাইম ট্রেডিং, বিতরণী ট্রেডিং এবং জুবায়ের ট্রেডিং।

এ ছাড়া এই সার আমদানিতে আইনুল হক ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে, ফাইজুর রহমান বকুল সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে, রফিকুল ইসলাম চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে, মোশাররফ হোসেন তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে, আমিনুর রশিদ খান মামুন, সাইফুদ্দিন মাহমুদ ও হাফিজুর রহমান প্রত্যেকে দুটি করে প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দেন। তবে তাদের কারও দরপত্রই গৃহীত হয়নি। সূত্র জানায়, নন-ইউরিয়া এই সার আমদানির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় এবং বিএডিসির কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে নির্দিষ্ট সংখ্যক সার আমদানিকারকরা গত আট-দশ বছর ধরে নিয়মিত একই পদ্ধতি অনুসরণ করে সার আমদানি করছেন। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকরা দরপত্রে অংশে নিলেও শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের কারণে তাদের দরপত্র বরাবর বাতিল হয়ে আসছে। সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট সদস্যরা আগে থেকেই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিভিন্ন নামে দরপত্র আহ্বান করেন। যাতে অন্যরা সুযোগ না পায়। যার ফলে কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই হাতেগোনা কয়েকজনই টেন্ডারের কাজ পেয়ে থাকে। ফলে একটি চক্রই বার বার লাভবান হয়। অথচ সার অধ্যাদেশ ২০০৭ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানের নামেই সার ব্যবসা করতে পারবে। অভিযোগ উঠেছে, এই দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে সরকারি মালামাল ক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর) লঙ্ঘন করা হয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী আমদানির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রচারণার কথা বলা থাকলেও তা মানা হয়নি। যার ফলে কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই হাতেগোনা কয়েকজনই টেন্ডারের কাজ পেয়ে থাকে। জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের কারণেই প্রতি বছর দেশে মানহীন নন-ইউরিয়া সারও আমদানি হচ্ছে। সারের মান নিশ্চিত করে প্রত্যেক কনসাইনমেন্টের নমুনা সরকার নির্দেশিত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু সেটিও যথানিয়মে হয় না বলে অভিযোগ আছে। বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত সার দেশে পৌঁছার পর সার আমদানি পরিদর্শন কমিটি আমদানিকৃত সার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সারের পরিমাণ, উৎস, মূল্য ও সারের গুণগতমানসহ অন্যান্য তথ্য যাচাইবাছাই করে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছে। অভিযোগ আছে, সিন্ডিকেটের সদস্যদের সুবিধা দিতে এই প্রত্যয়ন কমিটি সব সময় একই রকম প্রত্যয়ন করে থাকে।

সর্বশেষ খবর