শনিবার, ১৭ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঈদের আগেই দৃশ্যমান পদ্মা সেতু

লাবলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ

ঈদের আগেই দৃশ্যমান পদ্মা সেতু

ঈদে ঘরমুখো মানুষ পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান বাস্তবতা দেখতে পান এমন প্রত্যাশা নিয়ে সেতুর ওপর স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। এ লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। ইতিমধ্যে সেতু প্রকল্পে পিলার বসানোর কাজে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার এবং স্প্যান বসানোর কাজে ৪ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ক্রেন পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে কাজ করতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে সাড়ে ৪২ শতাংশ। পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম এমন তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সব কিছু ঠিক থাকলে রমজানের শেষের দিকে অর্থাৎ ঈদের আগেই পিলারের ওপর বসানো হবে স্প্যান (দুই পিলারের  সঙ্গে সংযোগ অবকাঠামো)। আর তখনই দৃশ্যমান হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম। তবে কবে সে দিন তা এখনো ঠিক করা হয়নি। চেষ্টা চলছে ঈদের আগেই যে কোনো দিন স্প্যান বসানোর। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে আবহাওয়া, নদীর গতি প্রকৃতির ওপরও। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সেতু বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষ্যে প্রকল্পে নিয়োজিত দেশি বিদেশি সব শ্রমিক দিনরাত শিফট ওয়াইজ কাজ করে চলছে। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর স্প্যানের ওপর বসানোর জন্য স্ল্যাব নির্মাণের কাজ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। মোট তিন হাজার স্ল্যাব বসানো হবে। এই স্ল্যাবের ওপর বিটুমিন দেওয়া হবে। এটির ওপর দিয়েই যানবাহন চলবে। পদ্মা নদীতে কাজ করছে ৪ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ক্রেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর হ্যামার যার রয়েছে ৩ হাজার কিলোজুল ভার দেওয়ার ক্ষমতা। ক্রেনের কাজ স্প্যানগুলোকে দুই পিলারের ওপর বসিয়ে দেওয়া আর বিশাল ওই হ্যামারের কাজ পিলারকে মাটির নিচে বসানোসহ পিলারের ফিটনেস পরীক্ষা করা। ফলে চলতি মাসে স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হলেই পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সবাই দেখতে পাবেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ সাড়ে ৪২ শতাংশ শেষ হলেও মূল কাজ শেষ হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা থেকে মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১০ কিলোমিটারের বেশি অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক, ৫টি সংযোগ সেতু, ৮টি আন্ডারপাস ও ২০টি কালভার্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির জাজিরা প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ শতকরা হিসেবে ৯৯ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ ১০০ শতাংশ, সার্ভিস এরিয়া-২-এর কাজ ১০০ শতাংশ, নদীশাসন কাজ ৩২ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ১৯৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছর (২০১৭-১৮) এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫২৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, এ পর্যন্ত সাড়ে ৪২ শতাংশ কাজ শেষ হলেও এর অগ্রগতি চোখে না পড়ার কারণ, প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজই হয়েছে পাইলিংয়ের কাজ। যা মাটির নিচে। এ ছাড়া সেতুর কাজে ব্যবহারের বেশিরভাগ জিনিস চীনে তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকে এনে পদ্মা সেতুর কাজে ব্যবহার করা হবে এবং হচ্ছে। পুরো সেতুতে ৪১টি পিলারের ওপর ৪০টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে ২০টি স্প্যান প্রস্তুত রয়েছে। যার মধ্যে ৭টি স্প্যান সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পিলারের ওপর বসার জন্য প্রস্তুত রয়েছে মাওয়ার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। ১৩টি খুব শিগগিরই চীন থেকে আসছে। স্প্যানগুলো চীনের চীন হোয়াং ডক থেকে জাহাজে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পৌঁছায়। পদ্মা সেতুর কাজের গতি বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার আনা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যামারটি আসার পর কাজের অগ্রগতি বেড়েছে। এ হ্যামারটিসহ বর্তমানে ৩টি হ্যামার পাইলিংয়ের কাজে নিয়োজিত রয়েছে, এগুলোর ক্ষমতা যথাক্রমে ৩ হাজার কিলোজুল, ২ হাজার ৪০০ ও ২ হাজার কিলোজুল। প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের আরও জানান, গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ শতাংশ। কিন্তু কাজ হয়েছে ৪২ দশমিক পাঁচ শূন্য শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ার কারণে কাজের গতি বাড়াতে হবে, যদি ঠিক সময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে চাই। সে লক্ষ্যে একটি নতুন হ্যামার আনা হবে। আর এখন যেখানে ৬টি কপার ড্রামে কাজ চলছে, তার পরিবর্তে ১৩টি প্লাটফরমে কাজ করা হবে। তখন কাজের অগ্রগতি বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ছয় সাত কিলোমিটার মেইন রোড ও দুই কিলোমিটার লিংক রোডের কাজ গত বছর জুলাই মাসে শেষ হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে ১০ দশমিক পাঁচ সাত কিলোমিটার (প্রায়) মেইন রোড, ৩ কিলোমিটার লিংক রোড, ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড ও ৬ কিলোমিটার ফেরি শিফটিং রোডের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। নির্বাহী প্রকৌশলী (অ্যাপ্রোচ রোড) সৈয়দ রজব আলী জানান, গত ডিসেম্বর মাসেই অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হলেও গত পাঁচ মাসে ধীর গতিতে বাকি ১৩ শতাংশ কাজ করতে হয়েছে। কারণ মাটি সেটেলমেন্টের ব্যাপার রয়েছে। এ ছাড়া সেতুর দুই প্রান্তে থানা তৈরির কাজও করে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দেশি-বিদেশি মিলে প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। সবমিলে বর্তমান সরকারে অন্যতম মেঘাপ্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ দ্রুত বাস্তবায়িত হতে চলেছে। যা বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভোগান্তির চির অবসান হবে। জীবনমান, যাতায়াতসহ উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্তের।

সর্বশেষ খবর