মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

কাসিদার ডাকে ঘুম ভাঙে পুরান ঢাকাবাসীর

ওঠো, ওঠো, ওঠো হে মমিন, সাহরি খাও

মাহবুব মমতাজী

কাসিদার ডাকে ঘুম ভাঙে পুরান ঢাকাবাসীর

সাহরির সময় শুরু হয়নি তখনো। কারও ঘুম ভেঙেছে। কেউ আড়মোড়া দিচ্ছেন বিছানায়। প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিছানা ছাড়ার। আবার কেউ ঘুমে বিভোর। এমন সময় অলিগলি থেকে ভেসে আসে সুরেলা আওয়াজ, ‘ওঠো, ওঠো, ওঠো হে মমিন, সাহরি খাও’। মধ্যরাতে, সাহরির আগে যারা গান গাইছেন তারা কারা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তারা শত বছরের ইতিহাস ধরে রাখা ঐতিহ্যের ‘কাসিদার দল’।

এটি পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বি কে দাস রোডের একটি ঘটনা। এখনো রমজান মাসে কাসিদার ডাকে সাহরিতে ঘুম ভাঙে পুরান ঢাকাবাসীর। ওই কাসিদার দলটিই কালীচরণ সাহা রোড ও সূত্রাপুর কাঁচাবাজার রোড ঘুরে বিভিন্ন গান-গজল গেয়ে ডেকে তুলেছেন আশপাশের বাসিন্দাদের। তবে তাদের মধ্য থেকে সাহরির সময় শেষ হওয়ার আগমুহৃর্ত পর্যন্ত ইসলামী গানের সুর পাওয়া যায়। কাসিদার ইতিহাস বেশ পুরনো। পুরান ঢাকায় যুগ যুগ ধরে কাসিদা গাওয়ার রীতি চলে আসছে। সময়টা পাল্টেছে তাই আগের মতো কাসিদা দলের সরগরম এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। কাসিদা দলের অন্যতম সদস্য আইয়ুব জানান, তারা শুধু ফরাসগঞ্জ ও সূত্রাপুরে সাহরিতে ডাক দেওয়ার কাজ করেন। আর লালবাগের হোসনি দালানের আশপাশে একটি দল কাজ করে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কালশীর বিহারি ক্যাম্পে কাসিদা দল আগের রেওয়াজ এখনো কিছুটা ধরে রেখেছে।

জানা গেছে, আগে ঢাকার সুবেদার-নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাসিদা গাওয়ার ব্যবস্থা হতো। পরে পুরান ঢাকার পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় তা টিকে ছিল। আস্তে আস্তে মসজিদের মাইকে সাহরিতে ডাক দেওয়া শুরু হওয়ায় কাসিদা গাওয়ার বিষয়টি আগের মতো আর জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয় না। আরবি শব্দ কাসিদার অর্থ প্রশংসামূলক কবিতা। রোজা, রোজাদার এবং রমজান মাসের নানা ফজিলত ও প্রশংসা বর্ণিত হয় কাসিদায়। সবার আগে মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষ গীতটি ঢাকায় চালু হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় তার প্রসার ঘটে। ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতির প্রধান সেনাপতি তার ‘বাহারস্থান-ই-গায়েবি‘ গ্রন্থে কাসিদার বর্ণনা দিয়েছেন। নবাব খাজা আহসান উল্লাহর সময়ে ঢাকায় কাসিদার ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল। সেই থেকে পুরান ঢাকায় কাওয়ালির সুরে উর্দু ভাষায় লেখা কাসিদা গাওয়া একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও জনপ্রিয় হিন্দি-উর্দু গানের সুরেও কাসিদা গাওয়া হতো। সূত্রাপুর কাগজী টোলার কাসিদা দলের প্রধান মাসুদ রহমান বলেন, ‘কাসিদা মূলত একটি কোরাস সংগীত। এটা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বহন করে। অন্যদিকে এটি সাহিত্য পর্যায়ে চিন্তা করা যায়। কাসিদা লেখা আর কবিতা বা গান লেখা একই বিষয়। এর মৌলিক সুর রয়েছে। তবে সেসব সুর তৈরি হয় কাওয়ালি, শাহেদি, ভৈরবী, নাতে রসুল, মালকোষ, মর্সিয়া এবং বিভিন্ন জনপ্রিয় হিন্দি-উর্দু গানের সুরকে অনুসরণ করে।’ ৮-১০ জন কাসিদা গায়ক মিলে কোরাস সুরে গান গাইলেও প্রধান গায়ককে বলা হয় সালারে কাফেলা। পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা আবদুস সবুর জানান, ‘আমাদের এখানে কাসিদা এক ধরনের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের চৌদ্দ পুরুষ থেকে এটি দেখে আসছি। যখন ছোট ছিলাম তখন কাসিদার দল ঢাক-ঢোল নিয়ে সাহরিতে ডাকাডাকি করত। এখন তো সেগুলো চোখে পড়ে না। প্রযুক্তির সম্প্রসারণে এ সংস্কৃতি অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে।’ তিনি জানান, ‘আমরা বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি কাসিদা রচয়িতা ছিলেন উর্দুভাষী ঢাকাইয়া কুট্টি ও অবাঙালি মুসলমান। নারায়ণগঞ্জের আদমজী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও নীলফামারীর সৈয়দপুর বিহারি ক্যাম্পের অনেকেই কাসিদা লিখেছেন।’

আরেক বাসিন্দা আহসান হাবিব জানান, ‘বর্তমানে ঢিমেতালে টিকে আছে পুরান ঢাকার কাসিদা। এখন আর একে রমজানের উৎসব হিসেবে গণ্য করা যায় না। এটা এখন গুটিকতক অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে কিছু কিছু এলাকায় রমজানের সাহরি খাওয়ার আহ্বান নিয়ে মহল্লা মহল্লায় ঘুরে থাকে সীমিত আকারে কাসিদা গায়কের দল।’ জানা গেছে, দিগু বাবু লেনের জুম্মন মিয়া, উর্দু রোডের মঞ্জুর আলম, খাজে দেওয়ান লেনের আবদুস সালাম, নলগোলার মানিক চান ও হোসনি দালান এলাকার সৈয়দ ফাসীহ হোসেনসহ আরও কিছু দলনেতা কাসিদা ঐতিহ্যে নিয়োজিত রয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর