বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

অন্য রকম ঈদ আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম শিশুপল্লীতে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

অন্য রকম ঈদ আনন্দ বৃদ্ধাশ্রম শিশুপল্লীতে

ঈদের দিন অন্য রকম আনন্দে মেতে উঠেছিলেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের বৃদ্ধ বাবা-মা ও শিশুপল্লীর শিশুরা। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে ব্যাকুল থাকেন স্বজনরা। ছুটে আসেন বাড়িতে বাবা-মা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের চিত্র। একই চিত্র শিশুপল্লী প্লাসেরও। এখানে আশ্রিত সেই সব মা-বাবা ও শিশুদের ঈদ উদ্যাপন হয় প্রিয় স্বজনদের কাছে না পাওয়ার আক্ষেপ বুকে নিয়ে। শুধু আক্ষেপ নয়, এ যেন সন্তান জীবিত থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। সকালে সেমাই, পিঠা খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যান এখানে থাকা বয়স্করা। সকাল ৮টার দিকে ঈদের নামাজ হয় এখানে। নামাজ শেষে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করতে দেখা যায়। নামাজের পর আশ্রয়কেন্দ্রে ভুনা খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা করেন। দুপুরে খেতে দেওয়া হয় সাদা পোলাও, গরু ও মুরগির গোশত। দুপুরের খাবারের পর দইও দেওয়া হয়। পবিত্র ঈদ উপলক্ষে আশ্রিত পুরুষদের নতুন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, লুঙ্গি এবং মহিলাদের নতুন শাড়ি দেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রের পক্ষ থেকে। ঈদের নামাজ, সকালের নাশতা, দুপুরে ভালো-মন্দ খাবার, নতুন জামা এসবের মধ্য দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বয়স্কদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন তারা। তবে সাময়িক এই আনন্দের মধ্যে চোখেমুখে অনেকটা হতাশার ছাপ দেখা যায়। টলমল চোখে তাকিয়ে থাকেন, এই বুঝি বাড়ি থেকে কোনো স্বজন এলো একটু সঙ্গ দিতে। কিংবা বাড়ি থেকে প্রিয় সেই খাবার নিয়ে এলো খাওয়াতে। ঈদের দিন সকাল থেকেই এই আশ্রিতরা অপেক্ষা করেন সন্তান-সন্ততি বা নিকটাত্মীয় কেউ এসে দেখা করবেন। কিছু সময় পাশে থাকবেন। কিন্তু আশা-নিরাশার মধ্য দিয়েই উৎসব আনন্দের ঈদের দিনটি কাটিয়ে দিতে হলো এসব অবহেলিত বৃদ্ধ বাবা-মাকে। ঈদের দিন কথা হয় আশ্রিত বৃদ্ধ মা-বাবাদের সঙ্গে। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কুলিয়া গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ ফিরোজ মিয়া (ছদ্মনাম)। দুই ছেলে এক মেয়ের জনক তিনি। ব্যক্তিজীবনে তিনি বেসরকারি চাকরি করতেন। কোনোমতে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সংসার চালাতেন। দুই ছেলে ও মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। কিন্তু ভাগ্য আজ তাকে টেনে নিয়ে এসেছে বৃদ্ধাশ্রমে। বুকে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। এমন ঘটনা এখানে আশ্রিত অনেক বাবা-মায়ের জীবনেই ঘটেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া ৮৪ বছরের ইয়াকুব আলী খান। তিনি বলেন, ‘আমার বড় ছেলে অনেক আগেই মারা গেছে। ছোট ছেলে বেসরকারি চাকরি করে। কিন্তু তার ঘরে ঠাঁই হয়নি আমার। আমার মেয়ে একদিন না জানিয়ে আমাকে এখানে এনে রেখে যায়।’ অন্যদিকে অসহায় অবহেলিত শিশু ও মাদের পুনর্বাসনে গড়ে উঠেছে শিশুপল্লী প্লাস নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে আশ্রিত শিশুরা এ বছর অনেকটা অন্য রকম আনন্দের মধ্যে ঈদ উদ্যাপন করল। বুকে চাপা কষ্ট থাকলেও দুঃখ-কষ্ট ভুলে সকালে বিশেষভাবে তৈরি ফিরনি খেয়ে শিশুরা ঈদের নামাজ পড়তে যায় এখানকার মসজিদে। আশ্রিত শিশুদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করেন। সকাল সোয়া ৮টার দিকে ঈদের নামাজ হয় এখানে। নামাজের পর আশ্রিত শিশুদের নিয়ে শিশুপল্লীর সদস্যরা সকালে সেমাই, পিঠা, পায়েস দিয়ে নাশতা করেন। পরে সাদা ভাত আর সাধারণ তরকারি দিয়ে দুপুরের খাবার খায় আশ্রিত শিশুরা। পবিত্র ঈদ উপলক্ষে আশ্রিত শিশু ও তাদের মাকে নতুন কাপড় দেওয়া হয়। বিশেষ করে এখানে ঈদ উৎসবে আশ্রিত শিশুদের আরও বেশি আনন্দ দিতে নেওয়া হয় নানা আয়োজন। তিন দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ঈদের আগের দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশ্রিত শিশু ও মাদের জন্য বিভিন্ন ইভেন্টের খেলা ও মিউজিকবিষয়ক নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় শুরু হয় মেহেদি উৎসব। যে যেভাবে খুশি মেহেদি দিয়ে হাত রাঙায়। ঈদের দিন রাতে শিশুপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা পেট্রিসিয়া কার নিজে উপস্থিত থেকে আশ্রিত মা ও শিশুদের সঙ্গে রাতের খাবার গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি নিজে সব বিষয়ে তদারকও করেন। ঈদের দিন রাতে আশ্রিত শিশুদের বিশেষ খাবার দেওয়া হয়। গরু, খাসি ও মুরগির গোশত তো থাকেই। পাশাপাশি সবজি, ডাল, নানা ধরনের পিঠা, পায়েসও থাকে রাতের খাবারে। ঈদের পরদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে শিশুদের জন্য নাচ, গান, ছড়া উৎসব ও মায়েদের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় তিন দিনের অনুষ্ঠানে বিজয়ী ও সব অংশগ্রহণকারীকে পুরস্কৃত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় সিনেমাও দেখানো হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ নাগরিক পেট্রিসিয়া কার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একজন ক্রু হিসেবে চাকরির সুবাদে একদিন ফ্লাইট বিরতির সময় ঢাকায় তিনি অবস্থান নেন। সে সময় তিনি ঢাকার ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে অবস্থিত ফ্যামিলি ফর চিলড্রেন নামের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যান। সেখানে বসে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি দেখতে পান, এক মা তার বুক খালি করে শিশুসন্তানটিকে ওই কেন্দ্রে ভর্তি করে রেখে যাচ্ছেন। আর ওই সময় শিশুটির মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশুসন্তানটিকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। তখন ওই শিশুসন্তান ও মায়ের কান্না দেখে ব্রিটিশ এই নাগরিক একটি শিশু আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হন, যেখানে শিশু ও মা উভয়েই থাকতে পারবেন। তিনি ১৯৮১ সালের দিকে প্রথমে বাংলাদেশে আসেন। এরপর তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করে নিজেই গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটির টেংরা এলাকায় শিশুপল্লী প্লাস গড়ে তোলেন।

 

সর্বশেষ খবর